রাসূল (সা.) বেদ্বীন কাফেরদের সাথেও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতেন। এমনিভাবেই রাসূল (সা.) দাওয়াতের ময়দানে তাদের লাঞ্ছনা ও কটু কথা, নির্যাতন ও নিপীড়ন সহ্য করতেন। তাদের সব ধরণের মন্দ আচরণকে তিনি উপেক্ষা করে চলতেন। রাসূল (সা.) সম্পর্কে কুরআনে কারীমে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : وَمَا أَرْسَلْنكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَلَمِينَ আমি আপনাকে সমগ্র জাহানের জন্য রহমত হিসেবেই পাঠিয়েছেন। ১৭ তিনি শুধু ঈমানদারদের জন্যে নয়; তিনি রহমাতুললিল আলামিন, সকল জগতের জন্য রহমত।
একবার ইহুদিদের অবস্থা চিন্তা করুন। তারা সে প্রসঙ্গে রাসূল (সা.)-এর নিন্দা করছে তার নিকট শত্রুতার আচরণ করছে। তারপরও রাসূল তাদের সাথে উত্তম আখলাক নম্র আচরণ করতেন, হাদীসে বর্ণিত আছে, আয়েশা (রা.) বলেন, ইহুদিরা একবার রাসূল (সা.)-এর ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। তখন তারা বলল আসসা-মু-আলাইকুম অর্থাৎ, তোমাদের মৃত্যু হোক! এমন পরিস্থিতিতে রাসূল (সা.) তখন কী করেন! একটুও ক্রোধান্বিত না হয়ে শান্ত ভাষায় বলেন, ওয়া আলাইকুম।
আয়েশা (রা.) তাদের কথা শুনে ক্রোধ সংবরণ করতে পারলেন না। তিনি বলেন, আসসালামু আলাইকুম অর্থাৎ, তোমাদের মৃত্যু হোক, আল্লাহ তোমাদের অভিশপ্ত করুন এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত নাযিল হোক। রাসূল (সা.) বলেন, হে আয়েশা! শান্ত হও। একটু ধৈর্য ধরো। সবার সাথে নরম ও কোমল আচরণ করতে হবে। কঠোরতা ও নিন্দনীয় আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
এভাবেই আয়েশা বলেন, আপনি শোনেননি, তারা কী বলেছে? রাসূল (সা.) বলেন, তাদের কথার উত্তরে আমি কী বলেছি, তা কি তুমি শোনোনি? আমি তাদের কথা তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছি। তোমাদের জন্য সে দোয়াই কবুল হোক, যা তোমরা আমার জন্য করেছো। আমার দোয়া আল্লাহ – কবুল করবেন, তাদের দোয়া কবুল হবে না।
কটু কথার জবাবে কটু কথা বলার কী প্রয়োজন আছে? অপর এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন: وَقُوْلُوْا لِلنَّاسِ حُسْنًا আপনি মানুষের সাথে সুন্দর কথা বলুন?” ১৯ একবার রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামগণ জিহাদ থেকে ফিরছিলেন। ফেরার পথে তারা উপত্যকায় তাবু ফেললেন। সাহাবারা তখন ছিটিয়ে বিভিন্ন গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়লেন। রাসূল (সা.) একটি গাছের দিকে এগিয়ে গেলেন। নিজের তরবারি গাছটির ডালের সাথে বেঁধে গাছের নিচে চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
তখন এক মুশরিক এতক্ষণ মুসলিম বাহিনীকে অনুসরণ করছিল। রাসূল (সা.)-কে একাকী বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ঘুমাতে দেখে সে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এলো ও তরবারিটি গাছের ডাল থেকে নিয়েছে। এরপর সে চিৎকার করে বলল, মুহাম্মাদ! আজ তোমাকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে? রাসূল (সা.) জাগ্রত হয়ে দেখেন, শিয়রে শত্রু দন্ডায়মান। হাতে উদ্যত তরবারি। তরবারির ফলায় যেন মৃত্যু চমকাচ্ছে। আল্লাহর রাসূল একাকী, নিরস্ত্র। শরীরে কোনো বর্ম নেই, পরনে শুধুমাত্র একটি কাপড়। সাথী-সাথীরা সকলে দূরে, বিক্ষিপ্ত, ঘুমে নিমগ্ন।
এদিকে মুশরিক লোকটি জয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে শক্তের উন্মাদনায় বারবার বলে যাচ্ছে, আজ তোমাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে? তার এরকম আচরণ এমন ও নাযুক পরিস্থিতিতেও আল্লাহর রাসূল শান্ত-প্রশান্ত, অটল- অবিচল। দৃঢ় আস্থার সাথে তিনি উত্তর দিলেন, আল্লাহ! সেই আল্লাহ আমাকে রক্ষা করবেন। রাসূল (সা.)-এর স্পষ্ট উচ্চারণে তার দেহ-মনে কম্পন সৃষ্টি হলো। হাত থেকে তরবারিটি পড়ে যায়। রাসূল (সা.) উঠে দাঁড়ালেন ও তরবারিটি হাতে তুলে নিয়ে বলেন, এখন বলো, আমার হাত থেকে তোমাকে রক্ষা করবে? এ কথা শুনতেই লোকটির চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়।
তখন, সে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন রাসূল (সা.)-এর কাছে ক্ষমা চাইতে শুরু করে। মিনতির স্বরে সে বলল, আপনার হাত থেকে আমাকে বাঁচানোর মতো কেউ নেই। আপনি সদাচরণকারী, তরবারি হাতেও সদাচরণকারী। আমার প্রতি দয়া করুন।
নবিজী (সা.) বলেছেন, তুমি কি ইসলাম গ্রহণ করবে? সে বলল, না। অবশ্য যারা আপনার সাথে যুদ্ধ করবে, আমি তাদের সহায়তা করব না। রাসূল (সা.) তাকে ক্ষমা করে দিলেন। সর্বোত্তম আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তাকে ছেড়ে দিলেন। ২০ ঐ লোকটি ছিল গোত্র প্রধান। নিজ গোত্রে ফিরে গিয়ে সে গোত্রের সকলেকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান ও তার আহ্বানে সমস্ত গোত্র মুসলমান হয়ে যায়। সুবাহানাল্লাহ। হ্যাঁ, এভাবে সুন্দর আচরণের মাধ্যমে আপনিও পারেন মানুষের হৃদয় জয় করতে, চরম শত্রুকেও বশে আনতে।
রাসূল (সা.) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রগুণের অধিকারী। চরিত্রগুণের জন্যেই তিনি মানুষের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছেন, হেদায়াতের দিশা দিয়েছেন, তাদের হৃদয় থেকে কুফরীর আবিলতা দূর করেন। যখন রাসূল (সা.) মানুষের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেন, কুরাইশের লোকেরা তার মোকাবেলা করতে শুরু করেন। এজন্য তারা সব রকমের পন্থা অবলম্বন করল। রাসূল (সা.)-এর দাওয়াতকে যেভাবে প্রতিরোধ করা হবে, ইসলামে গ্রহণকারীদের সাথে কী ধরণের আচরণ করা হবে তা নিয়ে তারা বড়দের সাথে পরামর্শ করল।
তাদের একজন বলল, তোমরা যাদুবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ও কাব্য শাস্ত্রে অভিজ্ঞ একজনকে খুঁজে বের করো। তাকে ঐ লোকের কাছে পাঠাও যে আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছে, আমাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করেছে, আমাদের ধর্মের নিন্দা করে চলেছে। সে তার নিকট কথা বলুক ও দেখুক, লোকটি কী বলে। চেয়ে অধিক যোগ্য আর সকলে বলল, আমরা এক্ষেত্রে ওতবা বিন রাবিয়ার কাউকে দেখছি না। তখন সবাই ওতবাকে বলল, ওতবা! তুমিই গিয়ে দেখো, সে কী বলে।
ওতবা ছিল ধৈর্যশীল, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ একজন নেতা। সে বলল, তোমরা আসলে তার সম্পর্কে কী ভাবছো? তোমরা কি চাচ্ছো, আমি তার নিকট কথা বলব ও বিভিন্ন ধরণের লোভ দেখিয়ে তাকে ভাগে আনতে চেষ্টা করব? তারা বললম হ্যাঁ, আমরা এজন্য চাচ্ছি। গেল। রাসূল (সা.) শান্তভাবে বসে তখন ওতবা রাসূল (সা.)-এর নিকট ছিলেন। ওতবা রাসূল (সা.)-এর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রথমেই বলল, মুহাম্মাদ।
বলো দেখি, তুমি উত্তম না তোমার পিতা আবদুল্লাহ উত্তম? এমন কথা শুনে রাসূল (সা.) চুপ রইলেন। পিতার সম্মান রক্ষার্থে তিনি কোনো কথা বলেন না। আর তখন ওতবা, আবার বলল, মুহাম্মাদ! বলো, তুমি উত্তম না আবদুল মুত্তালিব উত্তম?
তখন, এমন পরিস্থিতিতে দাদা আবদুল মুত্তালিবের সম্মান রক্ষার্থে তিনি কোনো কথা বলেন না। রাসূল (সা.) চুপ রইলেন। এদিকে ওতবা বলল, তুমি যদি মনে করো এরা সকলে তোমার চেয়ে উত্তম তাহলে তোমারও তাদের অনুসরণ করা দরকার। তখন, তারাও মূর্তিরই উপাসনা করতো। অথচ তুমি মূর্তির নিন্দা করতে আরম্ভ করেছো। যদি মনে করো তুমি তাদের চেয়ে উত্তম তাহলে এ কথাটাই তুমি মুখ ফুটে স্পষ্ট করে বলো। আমরা তোমার মুখ থেকেই এ কথাটা শুনতে চাই।
রাসূল (সা.) কোনো জবাব দেয়ার আগেই ওতবা খুব উত্তেজিত হয়ে বলল, আল্লাহর শপথ! আমি কোনো জাতির জন্য তোমার চেয়ে দুর্ভাগা ও কুলক্ষুণে কাউকে দেখেনি। তুমি আমাদের ঐক্যকে বিনষ্ট করেছো। আমাদের মাঝে বিরোধ সৃষ্টি করছো। আমাদের ধর্মের নিন্দা করেছো। সমস্ত আরবে আমাদেরকে অপমানিত করেছো। পুরো আরবে ছড়িয়ে পড়েছে, কুরাইশদের মাঝে একজন যাদুকরের আবির্ভাব হয়েছে। কুরাইশদের মাঝে একজন গণকের আবির্ভাব হয়েছে।
তখন, আমাদের এ অবস্থার চূড়ান্ত ভবিষ্যত হলো, একবার আমরা সকলে একে অন্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াবো ও লড়াই করতে করতে একে একে সকলে নিঃশেষ হয়ে যাবো। তখন কথাগুলো বলতে বলতে, ওতবা বেশ ক্রোধান্বিত হয়ে পড়েছিল। তার চেহারার রূপ বদলে গিয়েছিল। রাসূল (সা.) শান্ত-সমাহিত, নীরবে সব কথা শুনলেন। তখন ওতবা একে একে রাসূল (সা.)-এর সামনে বিভিন্ন লোভনীয় প্রস্তাব পেশ করতে শুরু করেন। উদ্দেশ্য ছিলো এসব লোভনীয় প্রস্তাব শুনে রাসূল (সা.) দ্বীনের দাওয়াত ছেড়ে দিবেন।
সে বলল, মুহাম্মাদ! তুমি যা কিছু করেছো, এসব যদি সম্পদ অর্জনের জন্য হয় তাহলে শোনো, আমরা তোমাকে এত সম্পদ সংগ্রহ করে দেবো, তুমি হবে কুরাইশদের মাঝে সব থেকে বড় ধনী। এছাড়া তোমার যদি নেতৃত্বের বাসনা থাকে, তাও বলে দাও। আমরা তোমাকে সমস্ত আরবের কর্তৃত্ব দিয়ে দেবো। তুমিই হবে সমস্ত আরবের একচ্ছত্র অধিপতি। এ সবকিছুই যদি হয় অপরূপা সুন্দরী কোনো নারীকে পাবার উদ্দেশ্যে তাহলে তাও বলো।
কুরাইশদের যে মহিলাকেই তুমি চাও তাকেই পাবে, আমরা তোমাকে প্রয়োজনে দশটি বিয়ে করিয়ে দেবো! -তুমি যে আচরণ করছো তা যদি জ্বীন বা ক্ষতিকর কোনো কিছুর প্রভাবে হয়ে থাকে, যা তুমি নিজ থেকে দূর করতে পারছো না তাহলে তাও বলো। আমরা তোমার জন্য ডাক্তার খুঁজে আনি এবং তোমার চিকিৎসা করি। এজন্য যত অর্থের প্রয়োজন, আমরা সব ব্যবস্থা করে দিবো। অনেক সময় দুষ্টু জ্বীন মানুষের পেছনে লাগে, তবে চিকিৎসা করলে এর সমাধান সম্ভব।
তখন এভাবেই, ওতবা অশালীন ভাষায় তার কথা বলেই চললো ও একের পর এক রাসূলকে বিভিন্ন ধরণের লোভ দেখাতে শুরু করে। রাসূল (সা.) অত্যন্ত সুন্দরভাবে তার কথা শুনছিলেন। সে রাসূল (সা.) বিভিন্ন ব্যাগের প্রস্তাব পেশ করে প্ররোচিত করার চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি। এদিকে রাসূল (সা.) শান্তভাবে সবই শুনলেন। রাজত্ব-নেতৃত্ব, অর্থ-সম্পদ সুন্দরী নারী, পাগলামির চিকিৎসা সব ধরণের লোভনীয় প্রস্তাব একসময় শেষ হলো। দীর্ঘসময় কথা বলে একসময় ওতবা থামলো।
এবার সে উত্তরের অপেক্ষায় আছে। রাসূল (সা.) তার দিকে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলেন, ওতবা। তোমার কথা শেষ হয়েছে? ওতবা সত্যবাদী-বিশ্বস্ত মহানবির এই শান্ত-সমাহিত ভাব দেখে মোটেও অবাক হলো না শুধু বলল, হ্যাঁ। রাসূল (সা.) বলেন, এবার তাহলে আমার কথা শোনো। সে বলল, ঠিক আছে। রাসূল (সা.) বলতে লাগলেন: الرَّحِيمِ بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْناً বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম। মানুষকে সুন্দর কথা বলতে থাকুন। রাসূল (সা.) তেলাওয়াত করেই যাচ্ছেন।
তখন ওতবা গভীরভাবে শুনছে একসময় ওতবা যমিনে বসে পড়লো। তার শরীর কেঁপে উঠলো। সে পেছনে হাত নিয়ে মাটিতে ভর দিয়ে শুনেই যাচ্ছেন রাসূল (সা.)-এর তেলাওয়াত। রাসূল (সা.) তেলাওয়াত করেই চলেছেন; যখন এ আয়াতে এসে পৌছেন: فَإِنْ أَعْرَضُوا فَقُلْ أَنْذَرْتُكُمْ صَاعِقَةً مِثْلَ صَاعِقَةِ عَادٍ وَثَمُودَ হে আল্লাহ! আমার অন্তরে হেদায়েত ঢেলে দিন এবং আমাকে আমার রিপুর । ২১ অনিষ্ঠ থেকে রক্ষা করুন তখন কঠিন আযাবের এ সতর্কবাণী ধমক শুনে ওতবা কেঁপে উঠলো।
রাসূল (সা.)-এর মুখের উপর হাত রাখলো, যেন তিনি তেলাওয়াত বন্ধ করে দেন। তিনি তেলাওয়াত করেই চললেন। তেলাওয়াত করতে করতে তিনি সেজদার আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলেন ও সেজদা করেন। রাসূল (সা.) সেজদা থেকে মাথা উঠিয়ে তিনি ওতবার দিকে তাকিয়ে বলেন, ওতবা! তুমি কি এতক্ষণ আমার তেলাওয়াত শুনেছো? সে বলল, হ্যাঁ শুনেছি। এটি হচ্ছে তোমার প্রশ্নের জবাব।
তখন, ওতবা উঠে তার সাথীদের কাছে চলে যায়। তারাও বড় আগ্রহের সাথে তার আগমনের অপেক্ষা করছিল। ওতবা তাদের কাছে পৌঁছতেই একজন বলে উঠলো, আল্লাহর শপথ! ওতবা আগের মত নেই। তার কিছু একটা হয়েছে। তার মাঝে নিঃসন্দেহে এক ধরণের পরিবর্তন ঘটেছে। এভাবেই ওতবার নিকট এসে বসে তারা বলল, কী ব্যাপার! কী সংবাদ নিয়ে এলে? ওতবা বলল, আল্লাহর শপথ! আমি মুহাম্মাদের কাছে এমন কিছু শুনেছি, যা জীবনে কখনো শুনিনি। আল্লাহর শপথ করে বলছি।
এগুলো কবিতা বা যাদু কিছুই নয়। এগুলো গণকবিদ্যাও নয়। হে কুরাইশের লোকেরা। তোমরা আমার কথা মানো। এই লোক যা করছে, তাকে তা করতে দাও। সে যা বলছে, তা নিঃসন্দেহে বড় কোনো সংবাদ হবে। হে আমার সম্প্রদায়! এটাই হলো বাস্তব সত্য। সে আমার সামনে বসে কিছু আয়াত তেলাওয়াত করে এভাবে সে পড়তে শুরু করেন: بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ حم . تَنْزِيلٌ مِنَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ . كِتَابٌ فُصِّلَتْ آيَاتُهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ بَشِيرًا وَنَذِيرًا . হামীম। এটি পরম করুণাময় অতি দয়ালু সত্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কিতাব।
এটি এমন কিতাব, যার আয়াতগুলোকে পৃথক পৃথক করে বর্ণনা করা হয়েছে, আরবী কুরআন পড়তে পারে এমন গোত্রের জন্যে। মানুষকে সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী। একপর্যায়ে এভাবে পড়েন: فَإِنْ أَعْرَضُوا فَقُلْ أَنْذَرْتُكُمْ صَاعِقَةً مِثْلَ صَاعِقَةِ عَادٍ وَثَمُودَ . তারা যদি আপনার কথা প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তাদেরকে বলুন, আমি তোমাদেরকে বজ্রপাতের ভীতি প্রদর্শন করছি, যেমনটি আপতিত হয়েছে আদ ও সামূদ গোত্রের ওপর। ২২ তখন আমি তার মুখে হাত চেপে ধরে আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে তাকে ।
তেলাওয়াত বন্ধ করতে বললাম। তোমরা জেনে রেখো! মুহাম্মাদ যখন কিছু বলে ফেলে, তার ব্যতিক্রম কখনো হয় না। তাই আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, সে যদি এ কথা বলে তাহলে তোমাদের ওপর আযাব নেমে আসবে। এ. এমন পরিস্থিতিতে ওতবা একটু সময় চুপ থেকে সে ভাবতে শুরু করে। পাশের । লোকেরা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। ওতবার কথা শুনে তারা হতবাক। ওতবা এ কী বলছে!
তখন সে বলল, আল্লাহর শপথ! মুহাম্মাদের কথায় এক ধরণের মিষ্টতা আছে। তার কথায় এক ধরণের সৌন্দর্যও আছে। তার কথার উপমা হতে পারে এমন একটি গাছ, যার শেকড়ে সর্বদা পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি থাকে। শাখাগুলো ফলে, ফুলে পূর্ণ থাকে। মুহাম্মাদের কথাও তেমনই। আর সেটা মেনে নিলে জীবন কল্যাণ ও মঙ্গলের ফলে-ফুলে পূর্ণ থাকে। তার নিকট রয়েছে মহান আল্লাহর রহমতের বৃষ্টির পর্যাপ্ত পানি। কোনোভাবেই তাকে পরাজিত করা সম্ভব নয়।
সেই সব বিষয়ে বিজয়ী হয়। সে তার বিপক্ষে থাকা সব কিছুকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। সে যা বলছে, কোনো মানুষ তা বলতে পারে না। তারা বলল, ওতবা। তুমি যা শুনেছো, তা কবিতা এদিকে ওতবা বলল, আল্লাহর শপথ! তোমরা এখানে যারা আছে, তাদের কেন্তু আমার চেয়ে কবিতা সম্বন্ধে ভালো জানো না। কবিতার ছন্দমিল ও পংক্তির সম্পর্কে তোমাদের মাঝে আমার চেয়ে বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ কেউ নেই। এমনকি জ্বীনদের কবিতা ও কবিতার পংক্তিমালার সম্পর্কেও আমার চেয়ে অধিক অবগত তোমাদের মাঝে কেউ নেই।
আল্লাহর শপথ! মুহাম্মাদ যা বলেছে সেগুলো এর কোনোটির সাথেই মেলে না। ওতবা রাসূল (সা.)-এর সম্পর্কে এমন মনোভাব নিয়ে তাদের সাথে বাগ-বিত-। করেই চললো। ওতবা ইসলাম গ্রহণ করেনি ঠিক, তবে ইসলামের প্রতি তার অন্তরে এক ধরণের ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামের প্রতি সে অনেকটা ঝুঁকে পড়েছিল। এটাই ছিল উত্তম ও মাধুর্যপূর্ণ আচরণ ও সঠিক কর্মদক্ষতার প্রভাব ও সঠিক কৌশলগত দিক। এদিকে ওতবা ছিল ইসলাম ও ইসলামের নবির চরম দুশমন। আরেক দিনের ঘটনা।
কুরাইশের লোকেরা একত্র হয়ে হুসাইন বিন মুনযির খোযায়ীকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে রাসূল (সা.)-এর সাথে কথা বলার জন্য পাঠালো। সে ছিল প্রসিদ্ধ ও মহান সাহাবী ইমরান বিন হুসাইনের পিতা। একবার আবু ইমরান রাসূল (সা.)-এর নিকট এলো। চারপাশে সাহাবায়ে ে কেরাম বসে আছেন। তখন আবু ইমরান রাসূল (সা.)-কে সে কথাই বলল, যা সে কুরাইশরা সবসময় বলে থাকে, তুমি আমাদের পারস্পরিক ঐক্য নষ্ট করেছো। সে আমদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করেছো। র রাসূল (সা.) মনোযোগের সাথে তার কথা শুনলেন। কিছুক্ষণ পর সে তার কথ দু শেষ করল। রাসূল নরম ভাষায় বলেন, আবু ইমরান! আপনার কথা শেষ হয়েছে সে বলল, হ্যাঁ।
কতই না সুন্দর আচরণ ছিল রাসূল (সা.)! মানুষের অন্তরে কত গভীর প্রভাব ছিল। কাফিরদের দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে ও তাদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিই সব থেকে কার্যকর। আমার একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা মনে হলো, একবার এক যুবক পড়াশোনা করতে জার্মানিতে যায়। সেখানে সে একটি ফ্লাটে ভাড়ায় থাকতো। তার সামনের ফ্লাটেই থাকতো একজন জার্মান যুবক। দুজনের মাঝে তেমন সম্পর্ক ছিল না। প্রতিবেশী, ব্যাস এতটুকুই। হঠাৎ করে জার্মান যুবকটি একবার কোথাও সফরে বের হয়।
হকার এসে প্রতিদিন তার দরজার সামনে পত্রিকা দিয়ে যেতো। প্রতিবেশী যুবক একবার দেখলো তার সামনের ফ্লাটের দরজার সামনে অনেক পত্রিকা জমা হয়ে আছে। খোঁজ নিয়ে সে জানতে পারলো, তার প্রতিবেশী কোথাও সফরে গিয়েছি। তখন সে পত্রিকাগুলো একত্র করল ও সেগুলো নির্দিস্ট একটি ড্রয়ারে সংরক্ষণ করে রাখলো। প্রতিদিন সে পত্রিকা সংগ্রহ করে সেগুলো বিন্যস্ত করে রেখে দিতো। দুই তিন মাস পর তার প্রতিবেশী জার্মান যুবকটি ফিরে এলো।
সে গিয়ে তাকে সালাম দিলো ও নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করায় তাকে স্বাগত জানায়। তারপর তাকে পত্রিকাগুলো দিয়ে বলল, আমার মনে হলো আপনি কোনো প্রবন্ধ নিয়মিত পড়ার জন্য বা পত্রিকায় কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য পত্রিকা সংগ্রহ করে থাকেন। আপনার প্রবন্ধপাঠ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ যেন না ছুটে যায়। এজন্য আমি এগুলো সংরক্ষণ করে সুবিন্যস্ত করে রেখেছি। তার এ কাজ দেখে সে অবাক হয়ে বলল, আপনি কি এর জন্য কোনো বিনিময়। বা প্রারিশ্রমিক চাচ্ছেন? সে বলল না, কোনো বিনিময়ের জন্য আমি এ কাজ করিনি।
আমাদের ধর্মড় আমাদেরকে প্রতিবেশীর সাথে এমন আচরণের শিক্ষা দেয়। আপনি আমার প্রতিবেশি। তাছাড়া আপনার সাথে সুন্দর আচরণ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। এভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সে তার নিকট সুন্দর আচরণ করে যেতে শুরু করেন। ফলে একসময় সেই জার্মান যুবক ইসলাম গ্রহণ করল। তা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উপভোগ্য বিষয় ছিলো। আপনার আচরণ সুন্দর করুন, আপনার জীবন হবে উপভোগের জীবন। ডানদিকের শূন্যের যেমন মূল্যা আছে, তেমনি আপনার জীবনেরও মূল্য আছে।
আপনার সকল কাজের আছে বিশেষ মূল্যায়ন। আপনি সব কাজই আল্লাহর ইবাদত হিসেবে করবেন। এমনকি মানুষের সাথে আপনার আচরণও হবে আপনার ইবাদতেরই অংশ। এটা ঠিক বর্তমানে অমুসলিমদের একটি বড় অংশ শুধুমাত্র অনৈতিক আচরণের কারণে ইসলাম হতে দূরে সরে আছে। তারা অমুসলিম শ্রমিকদের উপর জুলুম নির্যাতন করে; এমনিভাবে অতিরক্ত কাজ করতে তাদেরকে বাধ্য করে, অমুসলিম পড়শিদের উপর জুলুম নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
আসুন। আমর অমুসলিমদের সাথে আচরণে-উচ্ছারণে সর্বোত্তম নৈপুণ্যতা ও মাধুর্যপূর্ণ আচরণ করতে শুরু করি। এটা নির্মম সত্য যে, মুসলমানরা কখনো তাদের অমুসলিম কর্মচারীর ওপর অত্যাচার করে, কখনো বাজারে গিয়ে তাদেরকে ধোকা দেয়, আবার কখনে তাদের কাফির প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়।
মুসলমানরা যদি তাদের সাথে ইসলামের শিক্ষা দেয়া মাধুর্যপূর্ণ আচরণ করে তাহলে তারা ঈমানের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেবে। নিঃসন্দেহে আজ হতে নতুনভাবে শুরু করি।
আলোর ঝলক
সত্যিকারের মানুষ তো তিনি; যিনি অমুসলিমদের সাথে আচরণে-উচ্ছারণে মার্জিত ব্যবহার দিয়ে ইসলামের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলেন।
No Comment! Be the first one.