সর্বময় যে কাজটি আমি করতাম তাহলো কিছু কিছু মানুষের আচরণের প্রতি লক্ষ রাখতাম। তাদের সাথে আমি কয়েক বছর সময় কাটিয়েছি। তাদের ঠোটে কখনো মুচকি হাসি দেখেছি বলে আমার তেমন মনে পড়ে না। কখনো তাদেরকে আমি ঠোঁটের কোণে সৌজন্যবশত এক চিলতে হাসিও ফুটতে দেখিনি। কারো সাথে কথা বলার সময় কথা প্রসঙ্গে একটু হেসেছে, এমনটাও হয়নি। আমার মনে হয়, এই প্রকৃতির উপর তাদের বেড়ে উঠা। এই প্রকৃতি বাইরে তাদের পরিবর্তন হওয়ার ক্ষমতা রাখে না।
এছাড়া আমি আরো তাদের পরখ করে দেখেছি, নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে বলা উচিত নির্দিষ্ট কিছু মানুষের সাথে তাদের আচরণ ভিন্ন। আরো দেখলাম, ধনী ও বড় বড় পদমর্যাদা অধিকারী ব্যক্তিদের সাথে তারা হাসিমুখে কোমল ভাষায় কথা বলে। তখন আমি বুঝতে পরলাম, তারা এসব কিছু করছে শুধুমাত্র তুচ্ছ স্বার্থের কারণে। এজন্য সুন্দর আচরণের পরকালীন বিরাট প্রতিদান তাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। মুমিন ব্যক্তি সাদাচরণ ও আচরণ দক্ষতার প্রয়োগ হবে আল্লাহর জন্যে। তাই তা হবে ইবাদত।
এর মাধ্যমে সে আল্লাহর কাছে লাভ করবে মহা পুরস্কার। মুমিনের সুন্দর আচরণ ও আচরণদক্ষতার প্রয়োগ হবে না কোনো পদ বা সম্পদের আশায়। হবে না মানুষের প্রশংসা-প্রত্যাশায় বা সুন্দরী পাত্রীর পাণি-প্রার্থনায়। একজন মুমিনের সুন্দর ব্যবহার হবে একমাত্র মহান আল্লাহর জন্যে। আল্লাহ যেন তাকে ভালোবাসেন, তাকে মানুষের মাঝে প্রিয় করে দেন। সদাচরণকে যে ইবাদত মনে করে, ধনী-গরীব, প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, সাধারণ পিয়ন-সবার সাথেই সে সুন্দর আচরণ করে।
এবার ধরুন, আপনি কোনো সময় পথচলার জন্যে রাস্তা দিয়ে হাটছেন, একবার রাস্তার ঝাড়ুদার আপনার সাথে মোসাফাহার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো; অন্য একবার আপনি বড় কোনো কর্মকর্তার সাথে দেখা করতে গেলে সেও মোসাফাহার জন্য বাড়িয়ে দিলো; উভয়ের প্রতি আপনার মনোভাব, আপনার মনোযোগ, আপনার মুখের হাসি ও চেহারার প্রফুল্লতা কি সমান হবে? আমি তা বলতে পারি না, দু’ক্ষেত্রে আপনার আচরণে কোনো ভিন্নতা থাকে কিনা। নববী আখলাক কী ছিল? তা আমি আপনাদের জানাতে পারি।
অন্যের প্রতি রাসূল (সা.)-এর মনোযোগ ও কল্যাণকামনা, দয়া ও দো’আ ছিল সমান। এক্ষেত্রে আজ আপনি যাকে তুচ্ছজ্ঞান করেন, হতে পারে সে আল্লাহর কাছে বড় টি দামী। হতে পারে পদ ও পদবীর কারণে যাদের সাথে আপনি মিষ্টি আচরণ করেন, তাদের হাজার জনের চেয়েও এই সাধারণ মানুষটি আল্লাহ তা’য়ালার কাছে অনেক বেশি পছন্দের। আপনি জানেন না, আপনার কাছে যিনি অতি তুচ্ছ, আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা অনেক। রাসূল (সা.) তাদের সম্পর্কে বলেন: إِنْ مِنْ أَحَبَّكُمْ إِلَى وَأَقْرَبِكُمْ مِّنِّى مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَحَاسِنُكُمْ أَخْلَاقًا তোমাদের মধ্যে আমার সর্বাধিক প্রিয় ও কিয়ামতের দিন সব থেকে নিকটভাজন ব্যক্তি হবে সে, যার আখলাক সর্বাধিক সুন্দর।
রাসূল (সা.) আবদ কায়েস গোত্রের আহত সাহাবী মুনযির ইবনে আয়েযকে বলেন, আল্লাহ ও তার রাসূল পছন্দ করেন, এমন দুটি গুণ তোমার মাঝে আছে। কী সে গুণ দুটি? রাতভর নামায ও দিনভর রোযা? একবার রাসূল (সা.)-এর কথা শুনে আসাজ বিন আবদুল কায়স আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলেন, হে রাসূল! কী সে গুণ দুটি? রাসূল (সা.) বলেন: কর্মে ধীরস্থিরতা ও আচরণে নম্রতা। ২৭ রাসূল (সা.)-কে একবার সর্বোত্তম পুণ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে রাসূল (সা.) বলেন, সর্বোত্তম পুণ্য ও নেক কাজ হলো, মানুষের সাথে সদাচরণ ও সুন্দর ব্যবহার করা।
একবার বলা হলো, কোন আমলের বিনিময়ে মানুষ অধিক জান্নাতে যাবে? তিনি বলেন, তাকওয়া ও আল্লাহর ভয় এবং সদাচরণ ও সুন্দর ব্যবহার দ্বারা।
রাসূল (সা.) আরো বলেন: أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ أَيْمَانًا أَحَاسِنُهُمْ أَخْلَاقًا، الْمُوَظَؤُوْنَ أَكْنَافًا، الَّذِينَ يَأْلْقُوْنَ وَيُؤْلَفُوْنَ، وَلَا خَيْرَ فِيمَنْ لَا يَأْلَفُ وَلَا يُؤْلِّفُ পূর্ণ ঈমানদার তো সেই ব্যক্তি, যার আখলাক সুন্দর, আচরণ নম্র ও বিনম্র। যে অন্যের সাথে স্বাচ্ছ্যন্দের সাথে আচরণ করে, অন্যরাও তার নিকট স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে আচরণ করে। তার মাঝে কোনো কল্যাণ নেই, যার সাথে মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে দ্বিধাবোধ করে এবং সেও অন্যের কাছে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। مَا مِنْ شَيْءٍ أَثْقَلَ فِي الْمِيزَانِ مِنْ حُسْنِ الْخُلُقِ রাসূল (সা.) বলেন: কিয়ামতের দিন আমলের পাল্লায় অন্য কোনো আমল সদাচরণের মত ওযনদার হবে না।
হাদীসের এক বর্ণনামতে, রাসূল (সা.) বলেন: إِنَّ الرَّجُلَ لَيَبْلُغُ بِحُسْنِ خُلُقِهِ دَرَجَةَ قَائِمِ اللَّيْلِ وَصَائِمِ النَّهَارِ একজন আবেদ রাত জেগে ইবাদত করে এবং দিনভর রোযা রেখে যে মর্যাদা অর্জনই করতে পারে, উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে একজন মানুষ সে মর্যাদা অর্জন করতে পারে। ২ সদাচরণ ব্যক্তিকে উত্তম জগতে লাভবান করে। উম্মে সালামার সেই ঘটনাটি ৩২ স্মরণ করুন। একবার তিনি রাসূল (সা.)-এর সাথে বসে ছিলেন। এ সময় পরকাল ও পরকালের নেয়ামতসমূহের কথা স্মরণ হলে তিনি রাসূল (সা.)-কে বলেন, হে রাসূল। দুনিয়াতে কোনো মহিলার দুজন স্বামী ছিল। একজনের মৃত্যুর পর সে অন্য জনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। মৃত্যুর পর তার তিনজনই জান্নাতবাসী হলো। তাহলে মহিলা কার সাথে থাকবে?
রাসূল (সা.) কী জবাব দিলেন? যে স্বামী রাত জেগে অধিক ইবাদত করতো, তার নিকট? যে অধিক রোযা রাখতো, তার নিকট থাকবে? ইলম ও জ্ঞানের গভীরতায় যে অগ্রসর ছিল, তার নিকট? না, রাসূল (সা.) এগুলোর কোনোটিই বলেন না। রাসুল (সা.) বলেন, যার আচরণ ও ব্যবহার অধিক সুন্দর ছিল, তার নিকট থাকবে। এ কথা শুনে উম্মে সালামা খুব অবাক হলেন। রাসূল (সা.) তাকে অবাক হতে দেখে বলেন, উম্মে সালামা! উত্তম ব্যবহার দুনিয়া ও আখেরাতের সকল কল্যাণের সোপান।
সদাচরণ ও উত্তম ব্যবহার উভয় জগতের কল্যাণকে নিশ্চিত করে। পার্থিব জীবনে নিশ্চিত করে মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসার আসন। আর পরকালে মহান আল্লাহর অবারিত দান-প্রতিদান। একজন মানুষ যতই নেক আমল করুক, তার আচরণ যদি সুন্দর না হয়, সব আমল বরবাদ হয়ে যেতে পারে। একবার রাসূল (সা.)-এর কাছে এক মহিলার আলোচনা করতে গিয়ে বলা হলো, সে রোযা রাখে। অনেক অনেক নামাজ পড়ে। দান-সদকাও অনেক করে।
তবে আচরণে-উচ্চারণে সে প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয়। রাসূল (সা.) এ কথা শুনে বলেন, সে জাহান্নামী। মনে রাখতে হবে, প্রশংসিত সকল গুণের ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) ছিলেন সর্বোত্তম আদর্শ। দয়ায় ও বদান্যতায়, বীরত্ব ও সাহসিকতায়, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতায় তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠতম মানব। সততা ও সত্যতায়, বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতায় তিনি ছিলেন সর্বোত্তম আদর্শ। লাজ ও লাজুকতায় তিনি ছিলেন পর্দাবৃত কুমারী নারীর চেয়েও বেশি লাজুক। তাই মুমিনদের পূর্বে কাফিররাই, নেককারদের পূর্বে বদকারেরাই অকুণ্ঠ চিত্তে রাসূল (সা.)-এর এসব গুণের সাক্ষ্য দিতো।
প্রথম যেদিন রাসূল (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হলো ওহীয়ে ইলাহী ও খোদায়ী – প্রত্যাদেশ, দায়িত্ববোধে বিচলিত নবিজীকে সেদিন খাদিজা (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ! মহান আল্লাহ আপনাকে কখনো বিব্রত ও অপদস্থ করবেন না। কেন? এ অবিচল বিশ্বাস খাদিজা কোথায় পেলেন? তখন এ প্রশ্নের উত্তর খাদিজার জবানেই শুনুন তিনি বলেন, আপনি আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। এতীম-অসহায়দের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সর্বদা নিঃস্বাদের খোঁজখবর নেন। অতিথিদের আপ্যায়ন করেন।
সত্যের পথে যারা বিপদের সম্মুখীন হয়, তাদের সহায়তা করেন। সদা সত্য বলেন। আমানত রক্ষা করেন। ৩৪ ড. মুহাম্মদ বিন আবদুর রহমান আরিফী রাসূল (সা.)-এর স্তুতিতে অবতীর্ণ করেন এক শাশ্বত বাণী, যার তেলাওয়াতে আমরা ধন্য হচ্ছি, আরও হবো কিয়ামত পর্যন্ত: وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারি। রাসূল (সা.)-এর চরিত্র ছিল কুরআনের প্রতিচ্ছবি। কুরআন যেমন মূর্ত হয়ে উঠেছিল রাসূল (সা.)-এর আচরণে উচ্চারণে, কর্ম ও চরিত্রে। উক্ত প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন: وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ তোমরা সদাচরণ করো। নিশ্চয় আল্লাহ সদাচরণকারীদের পছন্দ করেন।
আর ভালো ব্যবহার করেন সবার সাথে। শিশু-বৃদ্ধ, ধনী-দরিদ্র, তুচ্ছ-অত্যুচ্চ সকলের সাথে তিনি করেন সর্বোত্তম ব্যবহার। তিনি শুনেছেন কুদরতি প্রত্যাদেশ: فَاعْفُوا وَاصْفَحُوا তোমরা ক্ষমা করো ও অন্যের অসদাচরণকে উপেক্ষা করো। তিনি ক্ষমা করেন অন্যকে, উপেক্ষা করেন সকল অসদাচরণকে। তিনি তিলাওয়াত করেন, وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنَاً তোমরা মানুষের সাথে ভালো কথা বলো। তখন তিনিও সর্বোত্তম ভাষায় মানুষের সাথে কথা কলেছেন। রাসূল (সা.) আমাদের জীবন আদর্শ। তার কর্মনীতি আমাদের জন্য শাশ্বত কর্মনীতি।
রাসূল (সা.) মানুষের সাথে কেমন আচরণ করতেন। তিনি কীভাবে মানুষের ভুল সংশোধন করতেন। কীভাবে কটূক্তি ও অত্যাচার বরদাশত করতেন। কীভাবে মানুষের শান্তির জন্য নিজের শাস্তিকে বিসর্জন দিতেন। কল্যাণের পথে মানুষকে আহ্বান জানাতে কীভাবে নিজেকে ব্যতিব্যস্ত রাখতেন। সিরাতের পাতা ওল্টান। আজ তিনি একজন অসহায় ব্যক্তির প্রয়োজন সম্পন্ন করার জন্য চেষ্টা করেন। আগামীকাল দুই মুসলমানের মাঝে সংঘটিত বিবাদের ফায়সালা করেন। আরেকদিন কাফিরদের দাওয়াত দিচ্ছেন।
এভাবে ধীরে ধীরে জীবনের সোনালী সময় কেটে গেছে। অস্থি-মজ্জা দুর্বল হয়ে পড়েছে। উপস্থিত হয়েছে জীবনের অন্তিম মুহূর্ত। একবার আয়েশা (রা.) রাসূল (সা.)-এর অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, বার্ধক্যে রাসূল (সা.) অধিকাংশ নামায বসে পড়তেন। কেন? কেন এমন হয়েছিল? এর কারণ, উম্মতের কল্যাণ কামনায় অমানুষিক পরিশ্রম, আর এ পথে পাওয়া কষ্ট তাকে করে ফেলেছিল দুর্বল। মন্ত্রের সাধন শরীর পতন এই হোক জীবনের সাধনা।
মূলত মানুষ যখন বড় ও মহান হয় তখন তার ইচ্ছা ও কামনাও অনেক বড় হয়। আর তার এই ইচ্ছা ও কামনা-বাসনা পূর্ণ করতে গিয়ে শরীর হয়ে যায় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। মানুষের সাথে সদাচরণে রাসূল এত আগ্রহী ছিলেন, তিনি দোয়ায় বলতেন: اللَّهُمَّ أَحْسَنْتَ خَلْقِي فَأَحْسِنُ خُلُقِي হে আল্লাহ! আপনি আমার বাহ্যিক আকৃতিকে যেমন সুন্দর করেছেন, তেমনই সুন্দর করুন আমার আচরণ ও ব্যবহারকে। তিনি এভাবে দোয়া করতেন: اللَّهُمَّ اهْدِنِي لِأَحْسَنِ الْأَخْلَاقِ، لَا يَهْدِي لِأَحْسَنِهَا إِلَّا أَنْتَ، وَاصْرِفُ عَنَّى سِيَّتَهَا، لَا يَصْرِفُ عَلَى سَيِّئَهَا إِلَّا أَنْتَ
হে আল্লাহ! আপনি আমাকে উত্তম আচরণ শিক্ষা দিন। আপনি ব্যতীত কেঃ উত্তম আচরণের পথনির্দেশ করতে পারে না। আমাকে অসদাচরণ হতে দূরে রাখুন। আপনি ব্যতীত কেউ অসদাচরণকে দূর করতে পারে না।৪০ আমাদের দায়িত্ব হবে, মুসলমানদের হৃদয় জয় করা; তাদেরকে ইসলামের সুমহান দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে রাসূল (সা.)-এর পূর্ণ অনুসরণ করা অমুসলিমদের সাথে উত্তম আচরণ মার্জিত আচরণ করতে হবে, যদি তাদেররে ইসলামের দিকে আনতে হয়।
ইশারা:
প্রথমত নিয়তকে বিশুদ্ধ করুন। তাহলে মানুষের সাথে আপনার আচরণঃ ইবাদতে পরিণত হবে।
No Comment! Be the first one.