মানুষের আখলাক, নৈপুণ্যতা একটি অমূল্য সম্পদ। বিশেষ করে এর উপর পরকালীন প্রতিদানই প্রকাশ করা আমার প্রকৃত উদ্দেশ্য নয়। এর মধ্যে ইহলৌকিক উপভোগ ও আনন্দ আছে, যা আপনি সরাসরি বুঝতে পারবেন। সকল মানুষের সাথে এর অনুশীলন করুন। বড়দের সাথে, ছোটদের সাথে, ধনী-গরীব, দূরের-কাছের সকলের সাথে সব ধরনের নৈপুণ্য অনুশীলন করুন। অন্যের ক্ষতি হতে রক্ষা পেতে কিংবা তাদের হৃদয়ে স্থান পেতে কিংবা তাদের সংশোধন করতে এর অনুশীলন করুন। অবশ্যই মানুষের সংশোধনের জন্যে প্রয়োজন দক্ষতা নৈপুণ্যতা প্রয়োগ করুন।
আলী বিন জাহম ছিলেন একজন কবি, সুসাহিত্যিক। তিনি ছিলেন রুঢ় স্বভাবের ও গোয়ার কিসিমের একজন বেদুঈন। সভ্য জীবনের কিছুই তার জানা ছিল না। জানা ছিল না সভ্য সমাজের রীতি-নীতি, আচার-আচরণ ও রুচি-পছন্দ। মরূপ্রান্তের যাযাবর জীবনের যতটুকু প্রত্যক্ষ করেন, জেনেছেন ও আত্মস্থ করেন ততটুকুই।
ঐ সময়ের খলীফা মুতাওয়াক্কিল ছিলেন একজন শক্তিশালী ও কঠিন শাসক। তাঁর মুখনিঃসৃত প্রতিটি কথা ছিল মূল্যবান। সকাল-সন্ধ্যা প্রজাগণ বিভিন্ন প্রয়োজনে তার নিকট হাজির হতো।
একবার বেদুঈন কবি আলি বিন জাহম বাগদাদে এলেন। কেউ একজন তাকে বললো, সুসমৃদ্ধ-ছন্দবদ্ধ কবিতার মাধ্যমে খলিফার যথোপযুক্ত প্রশংসা করতে পারলে তার নিকট মর্যাদাসম্পন্ন স্থান লাভ করা যায় ও পুরষ্কার করা এ কথা শুনে বেদুঈন কবি আলী বিন জাহম অত্যন্ত খুশি হন, তা শুনে তিনি খলিফার রাজপ্রাসাদের দিকে রওয়ানা করেন।
তিনি মুতায়াক্কিলের নিকট তিনি প্রবেশ করে দেখেন, বহু কবি-সাহিত্যিক সেখানে উপস্থিত। তারা স্বরচিত কবিতায় বাদশাহর গুণকীর্তন করছে ও তার করুণা লাভে ধন্য হচ্ছে। খলিফা মুতাওয়াক্কিলের প্রতাপ, গাম্ভীর্য শক্তির দম্ভ ছিল স্বীকৃত। এমনিভাবে বেদুঈন কবি আলি বিন জাহামও তার নিকট আসন গ্রহণ করে ছন্দে ছন্দে খলিফার প্রশংসায় কাসিদা আবৃত্তি শুরু করেন।
أَنْتَ كَالْكَلْبِ فِي حِفَاظِكَ لِلوُد وَكَالتَّيْسِ فِي قِرَاعِ الْخُطُوبِ
আপনি ভালোবাসার সংরক্ষণে কুকুরের মত এবং বিপদ প্রতিরোধে ষাড়ের মতো।
أَنْتَ كَالدَّلْوِ لَا لَا عَدِمْتُكَ دَلْوا مِنْ كِبَارِ الدَّلَا كَثِيرِ الذُّنُوبِ
আপনি কুয়োর বালতির মত। এত বড় বালতি, আমি খুইতে চাই না। এই বড় বালতি, অন্য বালতির পানি বাড়িয়ে দেয়।
ঐ সময়কার কবিগণ যেখানে বাদশাহকে তুলনা করতেন চন্দ্র, সূর্য, পর্বতশ্রেণীর সাথে, সেখানে আলী বিন জাহম যাযাবর জীবনের প্রথানুযায়ী তার কবিতায় বাদশাহকে তুলনা করতে শুরু করেন কুকুর, ছাগল, কুয়া ও মাটির সাথে। একপর্যায়ে খলিফা তার কবিতা শুনে প্রচ- রেগে গেলেন। উত্তেজনায় ফেটে পড়লেন। রাজপ্রাসাদে মুহূর্তে নীরবতা নেমে এলো। ভয় আতঙ্কের ছায়া সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। প্রহরীরা নড়েচড়ে উঠলো। জল্লাদ তরবারি খাপমুক্ত করে ফেলল। হত্যা করার বিশেষ মাদুর বিছিয়ে সে তাতে আলী বিন জাহমকে তাতে বসালো এবং তাকে হত্যার জন্য পূর্ণ প্রস্তুত হলো।
একপর্যায়ে খলিফা বুঝতে পারলেন, মূলত আলী বিন জাহম তাকে তুলনা করতে চাননি। যাযাবর জীবনের স্বভাব প্রকৃতির কারণেই তিনি তুলনা করেন। তার যাযাবর জীবনধারায় এগুলোই উমদা তাশবীহ ও শ্রেষ্ঠ তুলনা!
খলিফা তার এ স্বভাব দুর্বলতাকে পরিবর্তনের ইচ্ছা করেন ও তার সম্পর্কে বিশেষ নির্দেশ জারি করেন। বাদশাহর নির্দেশে ভৃত্যগণ তাকে এক মনোরম প্রাসাদে পৌছিয়ে দিলো। রাজ্যের রূপসী সব ক্রীতদাসীরা সেখানে তার করতো ও ভোগ ও উপভোগের যাবতীয় সামগ্রী সরবরাহ করতো।
এভাবেই আলী বিন জাহম সুরম্য অট্টালিকায় বসবাস করে ভোগের জীবন কাটাতে শুরু করেন। বর্ণাঢ্য সোফায় হেলান দিয়ে, কোমল গালিচায় শরীর এগিয়ে দিয়ে বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের সাথে খোশগল্প করে দিন কাটাতে শুরু করেন তিনি। এভাবে কেটে যায় দীর্ঘ সাত মাস।
একদিন খলিফা রাতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তখন আলী বিন জাহমকে ডাকা হলো। ভৃত্যগণ কবিকে খলিফার সম্মুখে উপস্থিত করল। খলিফা বলেন, আলী আমাদের জন্য কবিতা আবৃত্তি করে শোনাও। খলিফার নির্দেশে তিনি ছন্দে-ছন্দে কাসিদা শোনাতে শুরু করেন। তবে কবিতার শুরুটা ছিল এমন-
عُيُونُ المَهَا بَيْنَ الرُّصَافَةِ وَالْجِسرِ جَلَبْنَ الْهَوَى مِنْ حَيْثُ أَدرِى وَلَا أَدْرِي
রুসাফা ও সেতুর মাঝে নীলগাইয়ের মত চোখগুলো প্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার জানা-অজানা পথ দিয়ে।
أَعْدَنَ لِي الشَّوْقَ الْقَدِيمَ وَلَمْ أَكُنْ سَلَوتُ وَلَكِنْ زِدْنَ جَمْرًا عَلَى جَمْرٍ
তারা পুরোনা প্রেম আবার জাগ্রত করেছে; অথচ আমার অনুমান এখনও ভুল হয়নি। ওই চোখগুলো কয়লার উপর কয়লা রেখে জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ বাতাস দিয়েছে।
এরপর তিনি শব্দের ফুলঝুরি দিয়ে সকলের অনুভূতিতে নাড়া দিলেন। অভিনব, সুললিত পংক্তিমালা দিয়ে সকলের হৃদয়কে বিগলিত করেন। এভাবেই তিনি খলিফাকে একে একে চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্ররাজি, তরবারির সাথে তুলনা করে কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করেন।
তখন বেদুঈন কবি খলিফা আলী বিন জাহামের স্বভাব পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। আমাদের বন্ধু-বান্ধব, সন্তান-সন্ততির স্বভাব ও আচরণ আমাদেরকে মাঝে মাঝে পীড়া দেয়। আমরা কি কখনো চেষ্টা করেছি তাদের সেই স্বভাব পরিবর্তন করতে? আমরা কি পেরেছি তাদের স্বভাবজাত দুর্বলতাকে পরিবর্তন করে তাদেরকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তুলতে? তার চেয়ে বড় কথা হলো, সবার আগে আপনি নিজেকে বদলান। নিজের স্বভাবজাত দুর্বলতাগুলো ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠুন।
মলিনতাকে মুচকি হাসিতে রূপান্তর করুন। গোস্বাকে সহনশীলতায়, কার্পণ্যকে দানশীলতায় ও সংকীর্ণতাকে উদারতায় পরিবর্তন করুন। এটা খুব কঠিন কিছু নয়। এ জন্য প্রয়োজন শুধুমাত্র দৃঢ় সংকল্পের, প্রয়োজন ধারাবাহিক অনুশীলনের। এক্ষেত্রে প্রতিজ্ঞা, হিম্মত ও অনুসীলন খুবই জরুরি। তাই সাহসী হয়ে আজই শুরু করুন।
এছাড়া আমরা যদি রাসূল (সা.)-এর বরকতময় সিরাত অধ্যয়ন করি, তাহলে আমরা অনুভব করতে পারবো, মানুষের সাথে তিনি যে কত সুন্দর আচরণ করেন। চরিত্র মাধুরী দিয়ে তিনি মানুষের অন্তরকে কীভাবে জয় করে নিয়েছেন। তিনি লৌকিকতার আশ্রয় নেননি। এমন কখনো হয়নি, বাইরে সবার সাথে সুন্দর আচরণ করেন, এছাড়া সহনশীলতা প্রদর্শন করতেন আর যখনই ঘরে আসতেন তখন তাঁর ধৈর্য রাগ এবং নম্রতা রূঢ়তায় পরিবর্তন হয়ে যেতো।
এমনো হয়নি, সবার সাথে ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল অথচ গৃহে এসেই হয়েছেন, মলিনমুখ বা সবার প্রতি দয়াশীল, স্ত্রী-পরিবারের প্রতি ক্ষুব্ধ ও দয়াহীন। তাছাড়া তিনি সবসময় সর্বক্ষেত্রে সবার সাথে সর্বোত্তম আচরণ করতেন। তার আচরণে ছিল না কোনো কপটতা বা কৃত্রিমতা। তার চরিত্র ছিল অকৃত্রিম, সরল ও সর্বোৎকৃষ্ট। চাশত বা তাহাজ্জুদের নামাজের মত মানুষের সাথে উত্তম আখলাক প্রদর্শনকেও তিনি ইবাদত মনে করতেন। মুচকি হাসিকে তিনি আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম মনে করতেন। নম্র ব্যবহারকে তিনি মনে করতেন ইবাদত, ক্ষমা ও দয়াসুলভ আচরণকে তিনি গণ্য করতেন নেক আমল বলে।
মূলত সদাচরণ ও চারিত্রিক কোমলতাকে কেউ ইবাদত মনে করলে সর্বাবস্থায় সে তা বজায় রেখে আত্মতৃপ্তি পাবে। যুদ্ধাবস্থায় শান্তিকালীন অবস্থায়, ক্ষুধার্ত বা পরিতৃপ্ত অবস্থায়, সুস্থ বা অসুস্থাবস্থায়, আনন্দ বা নিরানন্দ-সর্বাবস্থায় সে হৃদয়ে তৃপ্তি অনুভব করবে। অনেক স্ত্রীগণ গৃহাভ্যন্তরে বসে স্বামীদের উদারতা, দানশীলতা ও সদাচরণের মত মহৎ গুণের কথা শোনেন। এজন্য বাড়িতে এর কিছুই তারা দেখেন না। তাছাড়া গৃহাভ্যন্তরে সেই উদার স্বামীর ব্যবহার থাকে রুক্ষ, মেজাজ থাকে খিটখিটে, হৃদয় সংকীর্ণ, চেহারা মলিন। কোমলমতি স্ত্রীদের প্রতি তারা হয়ে যায় দয়াহীন, মায়াহীন।
গৃহে রাসূল (সা.)-এর আখলাক নৈপুণ্যতা কেমন ছিল? উক্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন:
خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لِأَهْلِي
তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম তারা, যারা পরিবারের লোকজনের নিকট ভালো। তোমাদের মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি পরিবারের লোকজনের নিকট সর্বোত্তম।
র্ণনামতে, আসওয়াদ বিন ইয়াযীদ বলেন, আমি আম্মাজান আয়েশা (রা.). কে বললাম, রাসূল (সা.) বাড়িতে এসে কী কী করতেন? তিনি জবাবে বলেন, পরিবারের বিভিন্ন কাজে শরীক হতেন। নামাযের সময় হলে অযু করে নামাযের জন্য বেরিয়ে যেতেন।
আপনাকে বাবা-মায়ের সাথেও সর্বদা সুন্দর আচরণ করতে হবে। অনেকেই দূরের ব্যক্তিদের সাথে উত্তম আচরণ করে, দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করে, হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় কথা বলে ও বন্ধুসুলভ ব্যবহার করে। বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তানের মত যারা নিকটাত্মীয়, যারা উত্তম আচরণ পাওয়ার অধিক হকদার, তাদের সাথে তারা মন্দ ও রুক্ষ আচরণ করে। উত্তম ঐ ব্যক্তি যে তার পরিবারের সাথে, বাবা-মায়ের সাথে, অধীনস্থ কর্মচারীদের সাথে ও সন্তান- সন্ততি মূলত ঘরে বাইরে সকলের সাথে সদাচরণ করে।
এক বর্ণনামতে, আবু লায়লা (রা.) বলেন, আমি দেখলাম, রাসূল (সা.)-এর নিকট উপবিষ্ট ছিলেন। ইত্যবসরে নবী-দৌহিত্র হাসান বা হুসাইন রাসূল (সা.)-এর কাছে চলে আসলেন। নবিজী তাকে আদর করে কোলে বসালেন। একটু পরেই সে রাসূল (সা.) কোলে পেশাব করে দিলেন! আবু লায়লা বলেন, আমি দেখলাম, রাসূল (সা.) কোল থেকে পেশাব গড়িয়ে যাচ্ছে। তখন আমি দ্রুত ওই শিশুটিকে সরানোর জন্য এগিয়ে গেলাম রাসূল (সা.)-এর কোল থেকে তাকে নিতে। রাসূল (সা.) বলেন, আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও; তাকে তোমরা পেরেশান করো না। সেই বাচ্চার পেশাব করা শেষ হলে নবিজী পানি আনতে বলেন এবং নিজ হাতেই পেশাবে পানি ঢেলে দিয়ে পরিষ্কার করেন।
কি অপূর্ব ছিলো নববী আখলাক! উত্তম আখলাককে নবিজী নিজের স্বভাবগুণে পরিণত করেছেন। রাসূল (সা.)-এর চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে ছোট-বড় সকলে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন, এতে হতবাক কিছুই নেই।
সিদ্ধান্ত:
অন্ধকারকে তিরষ্কার করার পরিবর্তে নিজের আখলাককে প্রস্তুত করুন।
No Comment! Be the first one.