শৈশবের ঘটে যাওয়া সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সেই স্মৃতি এখনো আমাদের মানসপটে ভেসে আসে। ইচ্ছা করেও যেন আমরা সেসব অতিত আজো ভুলে যেতে পারি না। এছাড়া, একটু ফিরে যান আপনার শৈশবের দিনগুলোতে। এছাড়া মনে পড়ে অনেক জনসাধারণের উপস্থিতিতে বড় কোনো অনুষ্ঠানে কেউ আপনার প্রশংসা করেছিল। এগুলো এমন এক স্মৃতি, যা সবসময় মনের গভীরে মধ্যে গেথে থাকে। কখনো মোছে না, স্মৃতির পাতায় জমা হয়ে থাকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।
এরই পাশাপাশি আমরা জীবনের এমন কিছু দুঃখ-বেদনার স্মৃতিও স্মরণ করতে পারি যা শৈশবে ঘটেছিল। শিক্ষকের প্রহার, সহপাঠির সাথে ঝগড়া, কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতির কারণে পরিবারের কারো পক্ষ থেকে অপমান-লাঞ্ছনা, সৎ মায়ের পক্ষ থেকে প্রতিহিংসামূলক আচরণ-এ জাতীয় আরো কত স্মৃতি!
বিশেষ করে এসব ঘটনাও আমরা স্বাভাবিকভাবে ভুলি না। আমাদের অন্তরে ও স্মৃতির পাতায় এগুলো থেকে যায় সবসময় স্মৃতি হয়ে, স্মরণীয় হয়ে। শিশুদের সাথে একটু ভালো ব্যবহার, একটু কোমল আচরণের ফলে শুধুমাত্র ছোটরাই আকৃষ্ট হয় না, তাদের বাবা-মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও প্রভাবিত হন ও সবার সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়।
কিছু প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের বহু লোকের এ অভিজ্ঞতা আছে, ছোট ছোট ছাত্রদের বাবা-মায়েরা তার নিকট যোগাযোগ করে তার প্রশংসা করে জানিয়ে দেন, তাদের সন্তান তাকে খুব ভালোবাসে, সবসময় তার প্রশংসা করে। এছাড়া, তারাও তাকে ভালোবাসেন। কখনো কখনো তারা তাদের হৃদয়ের এ অনুভূতি উষ্ণতাপূর্ণ ও আন্তরিক দেখা, হাদিয়া বা পত্র পাঠানোর মাধ্যমেও ব্যক্ত করে থাকেন। এছাড়া, এজন্য ছোটদের হাসিমুখ, তাদের হৃদয়ের ভালোবাসা অর্জন, তাদের
সাথে কোমল ও উপযোগী আচরণের অনুশীলন এসব বিষয়কে মোটেই তুচ্ছ রাসূল (সা.) বলেন: মনে করবেন না। একবার আমি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের সামনে নামায সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। একপর্যায়ে আমি তাদেরকে নামাযের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি হাদিস বলতে বললাম।
একজন বলল, আমি বলতে পারবো। بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشَّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ মানুষ এবং কুফর বা শিরকের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে নামাজ ত্যাগ করা।
তখন তার এমন জবাবে আমি মুগ্ধ হলাম। আমি এত বেশি খুশী হলাম, যার কারণে আমার হাতের ঘড়িটা খুলে তাকে দিয়ে দিলাম। ঘড়িটি ছিল অত্যন্ত সাধারণ, শ্রমিকেরা সাধারণত যে ধরণের ঘড়ি ব্যবহার করে অনেকটা তেমনই। আমার সেদিনের ওই আচরণে ছেলেটি খুব খুশি হয়। সে পড়াশোনায় গভীরভাবে মনোযোগী হয়ে কুরআনে কারিম হিফযের গুরুত্ব অনুধাবন করে তাতে মনোনিবেশ করল। কয়েক বছর পর একবার এক মসজিদে নামায পড়তে গিয়ে আমি জানতে পারলাম, সেদিনের ছোট্ট সেই ছেলেটিই এখন এই মসজিদের ইমাম! এখন সে পূর্ণ যুবক। ইতোমধ্যে সে শরীয়া অনুষদ থেকে ডিগ্রী অর্জন করেছে এবং বর্তমানে সে বিচার বিভাগে চাকুরী করে। তার শৈশবের সেই ঘটনা আমার স্মরণ ছিল না।
সেই আমাকে অনেক আগের সেই ঘটনা মনে করে দিয়েছিল আপনি দেখুন, অনেক বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই সামান্য ঘটনা তার অন্তরে কী গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং আমার প্রতি কেমন ভালোবাসা ও মূল্যায়নবোধ তৈরি করেছে। একদিন আমি একটি ওলিমা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হই। হাস্যোজ্জ্বল চেহারার এক যুবক আমাকে আন্তরিকভাবে সালাম দিলো ও অনেক আগে তার নিকট ঘটে যাওয়া চমৎকার একটি ঘটনা আমাকে স্মরণ করিয়ে বলল, তার শৈশবকে আমি একবার তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো বিষয়ে বক্তৃতা করেছিলাম। তখনকার সে ঘটনাটি আজও তার ভালোভাবে মনে আছে।
তখন মসজিদ থেকে বের হয়ে ছোট ছোট ছেলেরা তার বাবার হাত ধরে টেনে একজন লোকের কাছে নিয়ে যায়। বাবা সেই লোককে সালাম করে এ কথা জানায়, তার ছেলে তাকে অত্যন্ত ভালোবাসে। এর একমাত্র কারণ এটাই, লোকটি ছোটদের সাথে ভালো ও সুন্দর ব্যবহার করে। বড় বড় দাওয়াত বা অনুষ্ঠানে যেখানে অনেক মানুষ উপস্থিত হয় সেখানেও এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে।
আমি সবসময় শিশুদের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। তাদের কচি মুখের মিষ্টি কথাগুলো মন দিয়ে শুনি। অথচ তাদের অধিকাংশ কথাবার্তাই সাধারণত অপ্রয়োজনীয় হয়ে থাকে। কখনো কখনো তাদের মা-বাবার প্রতি সম্মানার্থে এবং তাদের মন জয় করতে তাদের প্রতি একটু বাড়তি মনোযোগ দিয়ে থাকি। এমনিভাবে আমার একজন বন্ধু তার ছোট শিশুকে নিয়ে প্রায় আমার সাথে দেখা করতো। আমি শিশুদের প্রতি অনেক গুরুত্ব দিতাম এবং তাদের সাথে কোমল ও সুন্দর আচরণ করতাম।
হঠাৎ একবার আমার বন্ধুটি তার ছেলেকে নিয়ে একটি বড় মাহফিলে আমার সাথে দেখা করল। বন্ধুটি আমাকে সালাম দিয়ে বলল, বন্ধু! বলো, তুমি আমার ছেলেকে কি যাদু করেছো! আর কয়েকদিন আগে ওর শিক্ষক ক্লাসের সকলকে ভবিষ্যতের স্বপ্ন সম্পর্কে বলেন। একজন বলল, আমি ডাক্তার হবো। আরেকজন বলল, আমি ইঞ্জিনিয়ার হবো। আমার ছেলে বলল, আমি হবো শায়খ ড. মুহাম্মাদ আরেফী। এটা স্বাভাবিক যে, ছোটদের সাথে মানুষের আচরণ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে।
বড় কোনো মজলিসে যখন কেউ সকলের সাথে মোসাফাহ করে, পেছনে পেছনে তার সন্তানও তার দেখাদেখি সকলের সাথে মোসাফাহ করতে থাকে। তখন কেউ কেউ শুধুমাত্র বাবার সাথেই মোসাফাহ করে। ছোট সন্তানের প্রতি তাৎপর্যই দেয় না। কেউ তাচ্ছিল্যের সাথে হাতের সামান্য একটু অংশ বাড়িয়ে দিয়ে কোনমতে হাত মেলায়। কেউ কেউ তার নিকট হাসিমুখে মোসাফাহ করেন। হৃদ্যতার নিকট হাত বাড়িয়ে বলেন, এই যে বুদ্ধিমান ছেলে! আহলান! সাহলান! কেমন আছো? তখন, ছোট ছেলেটির অন্তরে এই লোকটির প্রতি একটি ভিন্ন ধরণের ভালোবাসা তৈরি হয়।
শুধুমাত্র কার অন্তরেই নয়, তার বাবা-মার অন্তরেও লোকটির প্রতি ভালোবাসা জন্মে। সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শের প্রতীক রাসূল (সা.)-এর আচরণও ছোটদের সাথে ছিল কোমল ও অনুকরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি আদর্শ। আনাস বিন মালেক (রা.)-এর ছোট একটি ভাই ছিল। রাসূল (সা.) তার নিকট রসিকতা করতেন। তাকে ডাকতেন আবু ওমায়র বলে। ছোট আবু ওমায়বের ছোট্ট একটি পাখি ছিল। পাখিটি নিয়ে আবু ওমায়ব সারাদিন খেলা করত।
হঠাৎ করে পাখিটি মারা গেল। তার নিকট দেখা হলে রাসূল (সা.) দুষ্টুমি করে তাকে বলতেন, আবু ওমায়র কোথায় তোমার নুগায়র কোথায়? আল্লাহর রাসূল নুগায়র বলে সে পাখিটিকে উদ্দেশ্যে করে বোঝাতেন। ১২ রাসূল (সা.) ছোটদের সাথে সহানুভূতির আচরণ করতেন। তাদের সাথে আনন্দ করতেন। তিনি উম্মে সালামার মেয়ে যয়নাবের সাথেও হাসি-ঠাট্টা করতেন। দুষ্টুমিও করতেন। তাকে বলতেন, ও যুওয়াইনিব! যুওয়াইনিব! কী খবর তোমার?
রাসূল (সা.) খেলায় মগ্ন শিশুদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদেরকে সালাম করতেন। আনসারদের এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে সালাম দিতেন, তাদের মাথায় হাত বোলাতেন। একদিন রাসূল (সা.) যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময়, তখন শিশুরা তাকে অভ্যর্থনা জানাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতো। রাসূল (সা.) তাদেরকে উটের ওপর তুলে নিতেন। তার পাশে তাদেরকে বসিয়ে রাখতেন। একদিন সাহাবায়ে কেরামগণ মুতার যুদ্ধ থেকে ফিরছিলেন। মুজাহিদ বাহিনী মদিনার একেবারে কাছে চলে এসেছিল।
রাসূল (সা.) মদিনাবাসিদের নিয়ে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে গেলেন। ছোট ছোট বাচ্চারাও তাদের ইসতেকবালের জন্য দৌড়ে এলো। আল্লাহর রাসূল ছোট বাচ্চাদের দেখতেই মুজাহিদদের বলেন, তোমরা এদেরকে তোমাদের উটে উঠিয়ে নাও। আর জাফরের ছেলেকে আমার কাছে দাও। জাফরের ছেলে আবদুল্লাহকে রাসূল (সা.)-এর কাছে নিয়ে আসা হলো। রাসূল (সা.) তাকে কোলে তুলে নিয়ে নিজের সামনে উঠিয়ে নিয়েছেন। একবার রাসূল (সা.) অযু করছিলেন। পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু মাহমুদ বিন রাবি রাসূল (সা.)-এর কাছে আসেন। রাসূল (সা.) মুখে পানি নিতেন। তারপর সেই পানি মাহমুদের চেহারায় ছিটিয়ে দিতেন। এভাবেই রাসূল (সা.) মাহমুদকে আনন্দ দিচ্ছিলেন।
রাসূল (সা.) সব সময় মানুষের সাথে হাসি-খুশী থাকতে পছন্দ করতেন। আপন আচরণের মাধ্যমে মানুষের মনে আনন্দ দিতেন। তার উপস্থিতি ও সংস্পর্শ কারো কাছে বিরক্তিকর মনে হতো না। একবার একজন লোক রাসূল (সা.)-এর নিকট এসে জিহাদ বা দূরে কোথাও সফরের উদ্দেশ্যে একটি উট চাইলো। তিনি তার নিকট একটু রসিকতা করে বলেন, আমি তোমাকে একটি উটনীর বাচ্চা দেবো। আর তখন লোকটি অবাক হয়ে গেল।
সে ছোট একটি উটের ওপর চড়বে কী করে? উটনীর বাচ্চা মানুষকে বহন করতেই পারে না। সে বলল, হে রাসূল! উটনীর বাচ্চা দিয়ে আমি কী করব! রাসূল (সা.) বলেন, উট উটনীর গর্ভেই জন্ম নেয়।” এক্ষেত্রে আমি তোমাকে প্রাপ্তবয়স্ক উটই দেবো। সেটি নিঃসন্দেহে কোনো উটনীর বাচ্চাই হবে। এমনিভাবে একবার রাসূল (সা.) রসিকতা করে আনাসকে বলেন, এই যে দুকানওয়ালা। ১৬ আরেকদিন এক মহিলা রাসূল (সা.)-এর কাছে নিজ স্বামীর সম্পর্কে অভিযোগ নিয়ে আসেন। রাসূল (সা.) তাকে বলেন, তোমার স্বামী কি সেই লোকটি, যার চোখ সাদা?! একপর্যায়ে রাসূল (সা.)-এর কথা শুনে মহিলা ভয় পেয়ে যায়। সে চিন্তা করলো, তার স্বামী অন্ধ হয়ে গেছে।
এর কারণ আল্লাহ তা’য়ালা হযরত ইয়াকুব (‘আ’)- এর সম্পর্কে বলেন, দুঃখ-বেদনায় কাঁদতে কাঁদতে তার দুচোখ সাদা হয়ে গেছে। অর্থাৎ তার দুচোখ অন্ধ হয়ে গেছে। তাই সে ভয়ে অস্থির হয়ে দ্রুত তার স্বামীর কাছে ফিরে এলো ও ভলো করে তার চোখ দেখতে লাগল! স্বামী তাকে বলল, কী ব্যাপার? স্ত্রী বলল, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমার চোখ নাকি সাদা হয়ে গেছে! এমন পরিস্থিতিতে স্বামী বলল, রাসূল (সা.) কি বলেননি, চোখের সাদা অংশ কালো অংশের চেয়ে বেশি?
সকল মানুষের চোখের কিছু অংশ কালো, কিছু অংশ সাদা। তবে সাদা অংশই বেশি থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। রাসূল (সা.)-এর সাথে কেউ রসিকতা করলে তিনি গ্রহণ করতেন, মুচকি হেসে আনন্দে শরীক হয়ে যেতেন। প্রদত্ত খোরপোস্টষের চেয়ে অধিক দাবি করায় একবার রাসূল (সা.) আপন স্ত্রীগণের প্রতি কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেন। এমন সময় উমর সেখানে উপস্থিত হলেন।
গলেন। এমনিভাবে উমর আরো অনেক কথা বলেছেন। তখন রাসূল (সা.) তার কথা শুনে হাসতে শুরু করেছেন। হাদীসের একবর্ণনায় উল্লিখিত হয়েছে, রাসূল (সা.) হাসতেন, তখন তাঁর দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত দেখা যেতো। রাসূল (সা.) মানুষের সাথে হাসি-খুশি থাকতেন। এমনিভাবে রাসূল (সা.)-এর আচরণে-উচ্ছারণে মজলিসের সকলের সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে যেতেন।
একটি ভাবনা:
আমরাও যদি সবার সাথে এমন আচরণ করতাম তাহলে আমরাও বাস্তব জীবনে এর বাস্তবতা দেখতে পারতাম।
No Comment! Be the first one.