মানুষের সাথে আপনার আচরণে-উচ্চারণে সকলকে এ কথা বুঝাতে সক্ষম হন, তাহলে অবশ্যই দেখবেন, তার কাছে মনে হবে সেই আপনার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়, আপনি সর্বোত্তম আচরণদক্ষতার অধিকারী হতে পেরেছেন। এখন থেকে আপনি মায়ের সাথে কোমল ও সুন্দর আচরণ করুন। গভীর ভালোবাসায় তাকে সিক্ত করুন। কমল ভাষায় তার নিকট কথা বলুন। যাতে করে তিনি অনুভব করতে বাধ্য হন, এমন ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ আর কারো সাথে আপনি করেন না।
এমন ভালোবাসা কাউকে বাসেন না। একই আচরণ করুন বাবার সাথে, স্ত্রী- সন্তানদের সাথে, বন্ধু-বান্ধবসহ সবার সাথে; এমনকি যাদের সাথে জীবনে একটিবার দেখা হচ্ছে যেমন, যদি কোনো দোকানদার বা পেট্রোল পাম্পের কর্মচারী তাদের সাথেও থেকে থাকে। সবাইকে যদি আপনি বুঝাতে সক্ষম হোন, সে আপনার সব থেকে প্রিয় মানুষ তাহলে তারা সকলে এক সাথে ভাববে, আপনি তাদের সব থেকে প্রিয় মানুষ। রাসূল (সা.) ক্ষেত্রে বিষয়টি এমনই ছিল।
আমরা সকল উত্তর তখন খুজে পাবো যখন সিরাতে নববীর পথে হাটবো। রাসূল (সা.) সবার সাথে সুন্দর মার্জিতভাষায় কথা বলতেন, হাসিমুখে কথা বলতেন। এমন আচরণ করতেন, সকলে মনে করত যে রাসূল (সা.) সব থেকে আমাকে ভালোবাসেন।
নিঃসন্দেহে জ্ঞানে-গুণে, মেধা ও প্রতিভায় প্রসিদ্ধ চারজন আরব মনীষির অন্যতম ছিলেন হযরত আমর বিন আস (রা.)। সে সময় গোটা আরবে চারজন ব্যক্তিকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আমর (রা.) ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি নিজ গোত্রের লিডার ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি লক্ষ করেন, পথে সাক্ষাত হলে রাসূল (সা.) তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন। মজলিসে উপস্থিত হলে রাসূল (সা.) তার আগমনে আনন্দ প্রকাশ করতেন। সবসময় হাসিমুখে তার নিকট কথা বলতেন, তার সব থেকে পছন্দনীয় নামে তাকে ডাকতেন। এমন আচরণ দেখে আমর (রা.)-এর মনে হলো, আমিই রাসূল (সা.)-এর সব থেকে প্রিয় মানুষ। এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে একবার তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করে বলেন, হে রাসূল! আপনার সব থেকে প্রিয় মানুষ কে? জবাবে রাসূল (সা.) বলেন, আয়েশা।
এরপর আমর (রা.) বলেন, সত্যিকারভাবে আমি জানতে চাই, পুরুষদের মাঝে আপনার সব থেকে প্রিয় ব্যক্তি কে? আমি আপনার পরিবার নিয়ে প্রশ্ন করছি না।
জবাবে রাসূল (সা.) বলেন, আয়েশার বাবা আবু বকর।
এরপর আমর (রা.) বলেন, তারপর কে?
রাসূল (সা.) বলেন, উমর ইবনুল খাত্তাব।
তখন আমর বলেন, তারপর? দ্বীনের জন্য কষ্ট বরণের ক্ষেত্রে অগ্রবর্তিতা হিসেবে এক একজন করে নাম বলতে লাগলেন। রাসূল (সা.) এবার ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্য। অমুক, তারপর অমুক, তারপর অমুক।
এমন পরিস্থিতিতে আমর (রা.) বলেন, আমার নাম সবার শেষে বলেন কিনা, এই ভয়ে আমি আর প্রশ্ন না করে চুপ হয়ে গেলাম।
রাসূল (সা.) কেমন চারিত্রিক মাধুর্যতার মাধ্যমে আমর (রা.)-এর মন জয় করে তাকে নিজের আপনর বানিয়ে নিয়েছিলেন।
রাসূল (সা.) সকলকে তার স্তর অনুযায়ী মর্যাদা দিতেন। তার প্রতি নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজনে আপন কাজ ছেড়ে দিয়ে তার কথা শুনতেন।
যখন ইসলামের বিজয় শুরু হলো, চারিদিকে মুসলমানদের বিজয়াকেতন উড়তে শুরু করে, রাসূল (সা.) সাহাবাদেরকে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে বিভিন্ন গোত্রে পাঠাতে শুরু করেন। কখনো কখনো প্রয়োজনে সেনাদলও পাঠাতে হতো। তারপর, ধারাবাহিকতায় রাসূল (সা.) তাঈ গোত্রের উদ্দেশ্যে সাহাবায়ে কেরামের একটি জামাত প্রেরণ করেন। তারপর, আদি বিন হাতেম ছিলেন তাঈ গোত্রের লিডার। যুদ্ধের ভয়ে তিনি পালিয়ে গেলেন। দেশ ছেড়ে পালিয়ে শামে আশ্রয় নিলেন। মুসলিম সেনাদল খুব সহজেই তাঈ-জনপদ জয় করে নিল। এর কারণ হলো তাদের নেতৃত্ব দেয়ার মত লিডারও নেই, লিডার না থাকায় সুসংগঠিত সৈন্যবাহিনীও নেই।
মুসলিম সেনাবাহিনী যুদ্ধের ময়দানে বিজিতদের সাথে সদাচরণ করেন। যুদ্ধক্ষেত্রেও শত্রুদের সাথে কোমল আচরণ করেন। মুসলিম বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র তাঈ গোত্রের অমুসলিমদের চক্রান্তের জাল ছিন্ন করা ও তাদের সামনে মুসলমানদের শৌর্য-বীর্য প্রকাশ করা। বনী তাঈ এর সাথেও এর বিপরীত হলো না। তাদেরকে বন্দী করা হলেও সবার সাথে ভালো আচরণ করা হলো। সকল বন্দীদের মদিনায় নিয়ে আসা হলো। এদের মাঝে আদি বিন হাতেমের বোনও ছিল।
রাসূল (সা.)-কে আদির পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ দেয়া হলে তিনি আশ্চর্য হলেন। কীভাবে সে নিজ সম্প্রদায়কে ছেড়ে পালিয়ে গেল? কোন ধরণের বুদ্ধির পরিচয় দিলো সে? শামে পালিয়ে গেলেও আদি সেখানে সুখের সাথে বসবাস করতে পারলেন না। কারণ সেখানে তার পরিচিত কেউ ছিল না। অবশেষে আদি নিজ দেশে ফিরে এলেন। মদিনায় এসে রাসূল (সা.)-এর নিকট উপস্থিত ছিলেন। এ ঘটনা আদি নিজেই বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন, রাসুল (সা.) আমার সব থেকে অপছন্দনীয় মানুষ ছিলেন। কারণ আমি ছিলাম একজন খৃষ্টান। স্বভাবতই রাসূল (সা.)-এর ইসলামের দাওয়াতে শুনে আমার মনে তার প্রতি অপছন্দ সৃষ্টি হলো। তবে কিছুদিন পর আমার সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। স্বপ্নের রাজপ্রাসাদগুলো চোখের সামনে ভেঙ্গে পড়লো। পালিয়ে শামে গিয়ে কোন রকম প্রাণে বাঁচলাম। শামের দিনগুলো আমার সুখে কাটলো না।
এখানে না থেকে আরবে ফিরে যাওয়াই আমার জন্য উত্তম হবে। আমি মুহাম্মদের কাছে ফিরে যাবো। মিথ্যাবাদী হলে সে আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। বাস্তবেই সে সত্যবাদী হলে তাকে অনুসরণ করতে আমার সমস্যা কোথায়? মদিনায় পৌঁছলে লোকেরা আমাকে দেখে বলাবলি করতে শুরু করে, ঐ দেখো আদি বিন হাতেম! ঐ দেখো আদি! শেষমেষ কোনো উপায় না পেয়ে ফিরে এসেছে। তবে আমি কারো কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা রাসূল (সা.) নিকট উপস্থিত হলাম। তারপর রাসূল (সা.) আমাকে দেখে বলেন, আদি বিন হাতেম নাকি? আমি উত্তরে বললাম, হ্যাঁ, আমি বিন হাতেম।
রাসূলুল্লাহ (সা.) আদির আগমনে আনন্দিত হয়ে তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা জানালেন। যদিও তিনি মুসলমানদের শত্রু, ইসলাম বিদ্বেষী, রণাঙ্গন থেকে পলায়নকারী ও খৃস্টান দেশে আশ্রয়গ্রহণকারী; তবুও তার নিকট সুন্দর আচরণ করেন।
তখন রাসূল (সা.) আদির হাত ধরে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন। আদি রাসূল (সা.) পাশে চলতে শুরু করেন। তার কাছে মনে হয়, যে উভয় মাথাই সমান! রাসূল (সা.) হলেন মদিনা ও তার আশেপাশের অঞ্চলের বাদশা। তিনি তাঈ- উপত্যকা ও তার আশেপাশের অঞ্চলের লিডার। রাসূল (সা.) রয়েছেন আল্লাহপ্রদত্ত সঠিক ইসলামের ওপর। তিনিও আসমানী ধর্ম খৃস্টধর্মের অনুসারী। মুহাম্মাদের নিকট রয়েছে আসমানী কিতাব আল-কুরআন, তার কাছে রয়েছে আসমানী কিতাব ইনজীল। তখন আদি ভাবলেন, শক্তি ও সৈন্যসামন্ত ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে আমার মাঝে ও রাসূল (সা.)-এর মাঝে তেমন কোনো তফাত – নেই। তারপর পথিমধ্যে তিনটি ঘটনা ঘটলো। তখন তারা উভয়ে পথ ধরে হাঁটছিল।
পথিমধ্যে একজন মহিলার সাথে তাদের দেখা হলো। মহিলা নবিজী (সা.)-কে দেখেই চিৎকার করে বলল, আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন। রাসূল (সা.) আদি বিন হাতেমের হাত ছেড়ে মহিলার কাছে গেলেন। কী হয়েছে জানতে চাইলেন। নীরবে তার কথা শুনতে থাকেন। জীবনে তো বহু রাজা- বাদশাহর আচরণ দেখেছেন আদি বিন হাতেম। এমন কখনো দেখেননি। তিনি অপলক নেত্রে তাকিয়ে দেখেন। দুনিয়ার রাজা-বাদশাহদের আচরণের সাথে রাসূল (সা.) আচরণ তুলনা করতে লাগলেন। মুগ্ধ হয়ে আদি বিন হাতেম দীর্ঘক্ষণ চিন্তা করেন। এরপর তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ! এমন আখলাক রাজা-বাদশাদের হতে পারে না। এ আখলাক রাসূল (সা.)-এর এমন আখলাক তো আম্বিয়ায়ে কেরামদের হয়ে থাকে!
এরপর, যখন মহিলার কথা শেষ হয়, তখন রাসূল (সা.) আদি বিন হাতেমের কাছে ফিরে এসে উভয়ে আবার হাঁটতে আরম্ভ করেন। কিছু দূর না যেতেই তাদের দেখা হলো আরেক ব্যক্তির সাথে। এরপর কি বলল সেই ব্যক্তি? সে যদি বলতো, হে রাসূল! আমার কাছে অনেক সম্পদ আছে। আমি সেগুলো দেয়ার জন্য দরিদ্র মানুষ খুঁজছি বলতো, আমার বাগান-ভূমিতে অনেক ফল-ফসল হয়েছে। আমি সেগুলো কী করতে পারি?
যদি তিনি কিছু বলতেন, তাহলে আদি বুঝতে পারতো মুসলমানদের সচ্ছলতা, মুসলমানদের স্বনির্ভরতা। তখন লোকটি বলল, হে রাসূল! আমি আপনার কাছে ক্ষুধা ও দারিদ্রের অভিযোগ করছি। লোকটি ছিল সীমাহীন দরিদ্র। খাওয়া-পরার কিছুই নেই। ছেয়ে-মেয়েদের ক্ষুধা নিবারণের মত কোনো খাবার নেই। আশেপাশে যে মুসলিমরা আছেন তাদেরও সামর্থ্য নেই তাকে সাহায্য করার। রাসূল (সা.) অবস্থা শুনে তাকে সান্ত্বনা দিলেন, কিছু কথা বলেন। আদি বিন হাতেম সবকিছু দেখেন, শুনলেন ও উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। ওই সময় তারা হাঁটতে শুরু করেন। কিছু দূর যাওয়ার পর আরেকজন লোক এলো। সে বলল, আল্লাহর রাসূল! আমাদের অনেক শত্রু থাকার কারণে আমরা পথ-ঘাটে নিরাপদে বের হতে পারি না। মদিনা থেকে বের হলেই চোর-ডাকাত আমাদের ওপর হামলা করে।
রাসূল (সা.) তার কথা শুনে তাকে এর সামাধান দিলেন এবং আরো কিছু কথা বলে আবার হাঁটতে আরম্ভ করেন। আদি বিন হাতেম এ বিষয়গুলো নিয়ে এবার গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেন। তিনি নিজে সীমাহীন মান-মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তার কোনো শত্রু নেই। ক্ষতিসাধনের অন্য কোথাও কেউ ওঁত পেতে বসে নেই। তাহলে কেন তিনি এমন ধর্ম গ্রহণ করবেন, যার অনুসারীরা সকলে দরিদ্র ও নিঃস্ব, অসহায়, দুর্বল ও নিরাপত্তাহীন?
এরপর তারা রাসূল (সা.)-এর গৃহে প্রবেশ করে আদি বিন হাতেম দেখেন, সেখানে একটাই বালিশ আছে। তিনি সেটা রাসূল (সা.) দিকে এগিয়ে দিলেন। এমন পরিস্থিতিতে রাসূল (সা.) মেহমানের সম্মানার্থে বালিশটি আদিকে দিয়ে বললেন নাও, তুমি বসো। আদি বিন হাতেম আবার সেটা রাসূলকে দিয়ে দিয়ে বলেন, না, আপনিই বসুন। আদি বিন হাতেম তা নিয়ে বসলেন। একবার রাসূল (সা.) ইসলাম ও আদি বিন হাতেমের মধ্যকার দূরত্ব দূর করতে মনোযোগী হলেন। কুফর ও শিরকের আপাত মজবুত প্রাচীরগুলো ভাঙতে আরম্ভ করেন। রাসূল (সা.) বলেন, আদি। তুমি ইসলাম গ্রহণ করে নাও। তাহলে উভয় জগতের নিরাপত্তা লাভ করবে। আদি বলেন, আমি একটা ধর্ম অনুসরণ করে চলছি।
রাসূল (সা.) বলেন, শোনো আদি! তোমার ধর্ম সম্পর্কে আমি তোমার চেয়ে অধিক অবগত আছি। আদি আশ্চর্য হয়ে বলেন, আপনি আমার ধর্ম সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি জানেন? রাসূল (সা.) বলেন, হ্যাঁ, আমি তোমার চেয়ে অধিক অবগত। আদি! তুমি কি রুকূসিয়াতের অন্তর্ভুক্ত নও? আর রুকূসিয়াত হলো খৃস্টধর্মের একটি শাখা। অগ্নিপূজারীদের ধর্মের সাথে এর কিছুটা সাদৃশ্য আছে। রাসূল (সা.) তাদের ধর্মের গভীরের সেই বিশেষ শাখা সম্পর্কেও অবগত আছেন। এটা ছিল রাসূল (সা.)-এর স্বতন্ত্র এক যোগ্যতা। তিনি এ কথা বলেননি, তুমি খৃস্টান। তার ধর্মে আরো গভীরে গিয়ে বলেন, তুমি রুকূসিয়াতের অন্তর্ভুক্ত।
যদি ইউরোপের কেউ আপনার সাথে দেখা করে সে আপনাকে বলে, তুমি খৃস্টান হয়ে যাও। আপনি বলেন, আমি একটি দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত আছি। তখন প্রত্যুত্তরে সে আপনাকে এ কথা বলল না, হ্যাঁ, আমি জানি তুমি মুসলমান। বলল না, হ্যাঁ, আমার জানা আছে তুমি সুন্নী। তাছাড়া সে বলল, হ্যাঁ, তুমি শাফেয়ী বা তুমি হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী। তার কথা শুনে আপনি নিঃসন্দেহে বুঝবেন, আপনার দ্বীন সম্পর্কে সে অনেক কিছুই জানে। এ দক্ষতাটিই আদির সাথে প্রয়োগ করেছিলেন রাসূল (সা.)।
তিনি আদিকে বলেন, তুমি কি রুকূসিয়াতের অন্তর্ভুক্ত নও? আদি বলেন, হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেন। রাসূল (সা.) বলেন, তুমি যখন কাওমের সাথে নিয়ে কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো তখন যুদ্ধলব্ধ সম্পদের এক চতুর্থাংশ নিজেই রেখে দাও। এজন্য না? আদি বলেন, হ্যাঁ, আমি এমনটিই করি। রাসূল (সা.) বলেন, এটা তোমাদের ধর্মে অবৈধ। তখন এটি শুনে আদি রাসূল (সা.) প্রতি দুর্বল হয়ে বলেন, হ্যাঁ আপনি সঠিক বলেছেন।
রাসূল (সা.) আদিকে লক্ষ করে বলেন, ইসলাম গ্রহণ করতে তোমার বাধা কোথায়, তা আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি বলবে, দুর্বল, অসহায় ও দরিদ্র লোকেরাই ইসলাম গ্রহণ করেছে। আরবের সম্পদশালীরা এই ধর্মকে মেনে নেয়নি। রাসূল (সা.) আদির প্রতি আরো আন্তরিক হয়ে বলেন, আদি। তুমি কখনো হেরাত গিয়েছো? আদি বলেন, আমি হেরাতের নাম শুনেছি। তবে কখনো যাওয়া হয়নি।
রাসূল (সা.) বলেন, কসম সেই মহান আল্লাহর! যার হাতে আমার প্রাণ! এই দ্বীন, এই ধর্ম একবার পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হবে। পবিত্র ধর্ম ইসলামের শান্তির বার্তা একবার সর্বত্র পৌঁছে যাবে। একজন নারী সেদিন সুদূর হেরাত থেকে একা একা সফর করে বায়তুল্লাহ যিয়ারত করবে। তার কোনো সফরসাথী থাকবে না। কোনো দেহরক্ষীর সহায়তা ছাড়াই শুধুমাত্র মাহরাম নিয়ে সে সুদূর হেরাত থেকে এসে হজ করে যাবে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বহু শহর-বন্দর অতিক্রম করে সে একাই মক্কায় পৌঁছে যাবে। কারো সাহস হবে না তার প্রতি সীমালঙ্ঘন করার, তার ওপর জুলুম করার বা তার সম্পদ কেড়ে নেয়ার।
ঐ সময় মুসলমানগণ সেদিন মহাক্ষমতাধর জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। একজন মুসলমানের পক্ষে সকল মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসবে বলে তার প্রতি কেউ চোখ তুলে তাকাবারও সাহস পাবে না।
এভাবেই আদি রাসূল (সা.) কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। কল্পনার চোখে যেন দেখতে শুরু করেন সেই দৃশ্য একজন নারী সুদূর হেরাত থেকে মক্কা নগরী পৌঁছাবে। তার সফরসাথী কেউ হবে না। তার প্রতি চোখ তুলে তাকাবার কেউ সাহস করবে না। মনে হচ্ছে সেই নারী এই উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্ত অর্থাৎ তার আদি কাওমের পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করবে? আদি আশ্চর্য হয়ে মনে মনে ভাবলেন, মরু কাঁপিয়ে বেড়ানো তাঈ গোত্রের যুদ্ধবাজ যুবকরা তখন কী করবে! তারা সে নারীকে ছেড়ে দেবে?!
রাসূল (সা.) বলেন, হে আদি! শোনো, এই মুসলমানগণ একবার কিসরা বিন হুরমুযের রাজভান্ডার কারায়ত্ত করবে। আদি বিন হাতেম আশ্চর্য হয়ে বলেন, বিন হুরমুযের রাজভান্ডার?! নবিজী (সা.) বলেন, হ্যাঁ, কিসরা বিন হুরমুষের রাজভান্ডার। মুসলমানগণ তার ধনভা-ার করায়ত্ত করবে। সম্পদ মহান আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবে।
রাসূল (সা.) আরো বলেন, জীবন তোমাকে সঙ্গ দিলে একবার তুমি দেখবে, একজন ব্যক্তি মুঠো ভরে স্বর্ণ-রূপা নিয়ে পথে পথে ঘুরবে। সদকা প্রদানের জন্য একজন গরীব মুসলমানও সে খুঁজে পাবে না। মূলত মানুষের ধন-সম্পদ তখন এত অধিক হবে, দরিদ্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে।
রাসূল (সা.) আদিকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নসিহত দিলেন। আখেরাতের কথা মনে করে তাকে বলেন, সেদিন কিছু লোক মহান আল্লাহর সাথে দেখা করবে। মাওলার সাথে তারা কথা বলতে পারবে না। মূলত, তাদের মাঝে কোনো দোভাষী থাকবে না। এরপর, সে তার ডান দিকে তাকাবে: জাহান্নাম ছাড়া কিছুই দেখবে না। বাম দিকে ফিরে তাকাবে। সেখানেও দেখবে জাহান্নামের প্রজ্জ্বলিত আগুন।
রাসূল (সা.)-এর নসিহত শুনে আদি বিন হাতেম নীরবে চিন্তা করতে শুরু করেন। নবিজী তাকে আরো বলেন, আদি! একত্ববাদের কালিমা পাঠ করে মুসলমান হতে কোথায় তোমার দ্বিধা? কোথায় তোমার বাধা? নাকি তোমার কাছে আল্লাহ তা’য়ালার চেয়ে মহান কোনো ইলাহর সন্ধান আছে?
আদি এবার বলেন, হে রাসূল! আমি ইসলাম কবুল করেছি। আমি এখন খাঁটি মুসলমান। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। আদি বিন হাতেমের ইসলাম গ্রহণে রাসূল (সা.)-এর আনন্দিত হন। তার চেহারা মোবারক উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একবার আদি বিন হাতেম (রা.) বলেন, আমি সে নারীকে দেখেছি, যে সুদূর হেরাত থেকে একটি উটের পিঠে চড়ে একা একাই পাবিত্র মক্কা নগরী সফর করেছে। হজ্বব্রত পালন করে একা একাই সে আবার হেরাত ফিরে গেছে। এই দীর্ঘ সফরে এক আল্লাহ ছাড়া কিছুর ভয় তার ছিল না। যারা কিসরা বিন হুরমুষের ধনভান্ডার যারা জয় করেছেন, আমিও তাদের সাথী ছিলাম। মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি! তৃতীয় ভবিষ্যত বাণীটিও সত্য প্রমাণিত হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন।
বিশেষ করে আদীর জন্য রাসূল (সা.)-এর এই মমতাপূর্ণ আচরণ নিয়ে একবার ভাবুন! আদীকে তিনি কেমন উষ্ণ সংবর্ধনা সম্মান মর্যাদা দিয়েছেন, যা আদী বুঝতে পারেননি। বিশেষ করে রাসূলুল্লাহ (সা.) এমন আচরণের জন্যে আদীর ইসলাম গ্রহণের জন্য বেশ সহায়ক হয়েছে।
মানুষ যেমনই হোক, আমরা যদি তাদের সাথে এমন ভালোবাসার ও মার্জিত আচরণ করতে পারতাম, তাহলে আমরা খুব সহজে তাদের হৃদয় জয় করতে পারতাম।
একটি ভাবনা:
কোমলতা ও উদারতা দিয়ে আমরা মানুষের হৃদয় জয় করতে পারি, আচরণ- নৈপুণ্যতা প্রয়োগ করে আমরা সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি।
No Comment! Be the first one.