বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মত বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে অনেকগুলো মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা বিদ্যমান। নিম্নে এদেশের অর্থনৈতিক মৌলিক সমস্যাবলী/উন্নয়নের বাধাসমূহ সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।
স্বল্প মাথাপিছু আয় এবং নিম্ন জীবনযাত্রার মানঃ বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। এই স্বল্প মাথাপিছু আয়ের কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকের জীবনযাত্রার মান দারিদ্র্য সীমার নীচে। বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় মাত্র ১৩৪০ মার্কিন ডলার অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডের জনগণের মাথাপিছু আয় ৩৬,০৮০ মার্কিন ডলার। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান কতটা নীচে।
কৃষির অনগ্রসরতাঃ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা অনুন্নত। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। জাতীয় আয়ের শতকরা ১২.৬৪ ভাগ আসে কৃষি থেকে। বাংলাদেশে এখনও প্রাচীন চাষ পদ্ধতি রয়েছে। জমিগুলো খন্ডিত ও বিচ্ছিন্ন, বিনিয়োগের মাত্রাও স্বল্প। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত উপকরণ, সেচ সুবিধা, উত্তম বীজ ও সার ব্যবহার এখন অত্যন্ত সীমিত। এই অনুন্নত চাষ পদ্ধতির কারণে বাংলাদেশের উৎপাদন অন্যান্য দেশের তুলনায় কম।
শিল্পের অনগ্রসরতাঃ বাংলাদেশ শিল্পে অত্যন্ত অনগ্রসর। মূলধনের স্বল্পতা, কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির অভাব, কারিগরী ব্যবস্থা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব সর্বোপরি কুশলী উদ্যোক্তার অভাবে এদেশ শিল্পের দিক থেকে অনুন্নত রয়েছে।
জনসংখ্যা বিস্ফোরণ: বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ দেশ। আয়তনের তুলনায় এখানে লোকসংখ্যা এত অধিক যে জনসংখ্যাধিক্যের সমস্যা আমাদের উন্নয়ন প্রয়াসকে ব্যাহত করছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭%। এই হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০২৫ সাল নাগাদ মোট জনসংখ্যা হবে ২১ কোটি। এই বিপুল জনসংখ্যার চাপ বাংলাদেশের অন্যতম মৌলিক সমস্যা।
দক্ষ শ্রমশক্তির অভাব: বাংলাদেশের আর একটি মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা হলো দক্ষ জনশক্তির অভাব। আমাদের পর্যাপ্ত জনশক্তি আছে কিন্তু দক্ষ জনশক্তির যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
দক্ষ সংগঠকের অভাবঃ বাংলাদেশে উন্নয়নের জন্য দক্ষ সংগঠক প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই স্বল্প। ফলে শিল্প ও কলকারখানা বা স্ব-উদ্যোগে কর্মসংস্থান গড়ে তোলার শত ঝুঁকি গ্রহণেচ্ছু ব্যক্তি খুবই কম।
মূলধনের স্বল্পতাঃ বাংলাদেশের লোকের মাথাপিছু আয় অত্যন্ত কম। তাই সঞ্চয়ের হারও কম। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মূলধন গঠনের হার কম। আমাদের সঞ্চয়ের হারও খুব কম। উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার জন্য সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের হার কমপক্ষে ২৫% হওয়া প্রয়োজন।
বেকার সমস্যা: বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক সমস্যা হচ্ছে বেকার সমস্যা। বাংলাদেশে জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে না ফলে বেকার সমস্যা বেড়েই চলেছে। আমাদের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৩০ ভাগ বেকার।
অনুন্নত অবকাঠামো: অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কতকগুলো মৌলিক সুযোগ সুবিধা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠা প্রয়োজন। যেমন- উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, রেলপথ, বাধ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, বন্দর, ব্যাংক ইত্যাদি। অনুরূপভাবে সামাজিক বুনিয়াদ বা অবকাঠামো, যেমন- স্কুল, কলেজ, কারিগরি জ্ঞান, প্রশাসনিক দক্ষতাও গড়ে ওঠা প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশে এর কোনটিই তেমন উন্নত নয়। অনুন্নত অবকাঠামোর জন্য এখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি অত্যন্ত মন্থর।
প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা ও অপূর্ণ ব্যবহার : বাংলাদেশের লভ্য প্রাকৃতিক সম্পদ জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। প্রয়োজনীয় মূলধন ও কারিগরি জ্ঞানের অভাবে আমাদের খনিজ সম্পদের পরিমাণ ও উত্তোলন কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। ভারী শিল্প গড়ে তোলার জন্য লোহা, কয়লা ও অন্যান্য ধাতব পদার্থ আমাদের দেশে কম। শিল্পায়ন প্রয়াস এজন্য ব্যাহত হচ্ছে।
বৈদেশিক বাণিজ্যের উন্নতি: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আমাদের আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম। বাণিজ্যের এ ঘাটতি অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট বাধা।
সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের অসুবিধা: স্বাধীনতার পর যে কয়টি পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তার ভিত্তি বাস্তবায়নের মান কোনটিই আশানুরূপ হয়নি। গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন সবসময়ই অবহেলিত ছিল। গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুবিধা বা কুটির শিল্পের যথোপযুক্ত উন্নয়ন এখনও ঘটেনি। নগর জীবনেও নানান জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সামগ্রীকভাবে দারিদ্রদ্র্য বিমোচন বা মানুষের জীবনের গুণগত মান উন্নয়নে কোনটিকেই কাঙ্খিত পর্যায়ে আনা সম্ভব হয়নি।
মুদ্রাস্ফীতি ও বাংলাদেশে দ্রব্যসামগ্রীর দাম স্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দেশে অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতি বিরাজমান। এটি অথনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বিরাট বাধা।
দারিদ্রের দুষ্টচক্র: বাংলাদেশের অন্যতম অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য হলো এখানে দারিদ্রের দুষ্টচক্র বিদ্যমান। এখানে লোকের আয় কম বলে বিনিয়োগের পরিমাণ কম। বিনিয়োগ কম হবার ফলে কর্মসংস্থান কম।
ঋণখেলাপীদের দৌরাতা : ঋণখেলাপীরা আমাদের অর্থনীতির প্রধান শত্রু। খেলাপী ঋণ আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে প্রধান বাধা। ঋণগ্রহীতারা নানা প্রভাব-প্রতিপত্তির মাধ্যমে বিনিয়োগের নামে শত শত কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নির্ধারিত খাতে বিনিয়োগ না করে অন্য কোনো অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে। এই খেলাপী ঋণের হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়মিত পরিশোধ করা হলে উক্ত টাকা পুনঃবিনিয়োগের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতি লাভবান হতো। কিন্তু ঋণ খেলাপীর ফলে দেশ সমৃদ্ধির সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আমদানি নির্ভরতা: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে রপ্তানীর তুলনায় আমদানির আধিক্যের কারণে বাণিজ্যিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি সৃষ্টি করে। প্রতিটি আর্থিক বছরে এই ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে আসছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি ২০১৫ পর্যন্ত এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬.৩৭৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই আমদানি নির্ভরতা তথা বাণিজ্যিক ঘাটতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করছে।
No Comment! Be the first one.