যদি সত্যিকারভাবে মানুষের স্বভাব নিয়ে গবেষণা করে থাকেন তাহলে দেখবেন, যমিন যেমন বিভিন্ন প্রকারের, মানব প্রকৃতিও তেমনই বিভিন্ন প্রকারের। কিছু মানুষের স্বভাব অনেক নরম ও কোমল হয়, আবার কিছু মানুষ শক্ত ও কঠিন। উর্বর ফসলী জমির মত অনেকে উদার। আবার অনেকে হয় কৃপণ, ঠিক অনাবাদী-অনুর্বর ভূমির মত, যাতে না পানি জমে, না ফসল ফলে। মূলত, মানুষ। অভিন্ন স্বভাবের নয়। আর ধরণ অনুসারে আমরা যমীনকে ব্যবহার করি। যমীন।
যদি শক্ত হয়, আমরা সাবধানে চলাফেরা করি। অন্যদিকে যমীন যদি নরম হয়, নির্দিধায় চলাফেরা করি। মানুষের বিষয়টিও এমনই হয়। রাসূল (সা.) বলেন: إِنَّ اللهَ خَلَقَ آدَمَ مِنْ قَبْضَةٍ قَبْضَهَا مِنْ جَمِيعِ الْأَرْضِ، فَجَاءَ بَنُوْ، آدَمَ عَلَى قَدْرِ الأَرْضِ فَجَاءِ مِنْ الْأَرْضِ يَضُ، وَالْأَسْوَدُ وَبَيْنَ ذَالِكَ وَالسَّهْلُ وَالْحَذْنُ وَالْخَبِيثُ وَالطَّيِّبُ. আল্লাহ তা’য়ালা আদম (আ)-কে সমগ্র জমিন থেকে একত্রিত করা একমুষ্টি মাটি থেকে সৃষ্টি করেন। বনী আদম পৃথিবীতে এসেছে মাটির হিসসা অনুযায়ী। কেউ লালা, কেউ সাদা, কেউ কালো কেউ মাঝামাঝি বর্ণের হয়ে থাকে।
আবার স্বভাবের দিক দিয়ে মানুষ বিভিন্ন প্রকারের হয়। কেউ মিশুক স্বভাবের, কেউ বা মনমরা, আবার কেউ খারাপ, কেউ ভালো। আমি বলব, আত্মীয় হোক; যেমন বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান অথবা অনাত্মীয় হোক, যেমন প্রতিবেশী, সহপাঠী, বিক্রেতা-সব মানুষের সাথে আচরণ করার সময় এ বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ রাখা উচিত। 88 মানুষের এ স্বভাবভিন্নতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে, এমনকি তাদের সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। আপনি নিজে এটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
এক্ষেত্রে যদি স্ত্রীর সাথে আপনার ঝগড়া হলো। এখন আপনার যে বন্ধুটি সব থেকে শক্ত মেজাযের, তার কাছে পরামর্শ চান। তাকে বলুন, ভাই। আমার স্ত্রী আমার জন্য এক বড় সমস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাকে সম্মান করে না, আমার সাথে যা-তা আচরণ করে।
এমনিভাবে সে বলবে, মহিলাদের নিয়ন্ত্রণ করার একটাই অস্ত্র। তাদেরকে ভয় ও রাগ দেখিয়ে কাবু করে রাখা। সবসময় চোখ গরম করে কথা বলা। আরে! নিজস্ব ব্যক্তিত্ব অর্জন করো। পুরুষের মত পুরুষ হও। আপনি যদি তার পরামর্শ গ্রহণ করে বাড়ি ফিরে যান ও তা প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেন তাহলে আপনাদের মধ্যে বিচ্ছেদও ঘটতে পারে। এদিকে পরীক্ষাটি পূর্ণ করতে এ পর্যায়ে আপনি আপনার সব থেকে কোমল স্বভাবের একজন বন্ধুকে বেছে নিতে পারেন ও আগের বন্ধুকে যা বলেন তাকেও তা বলুন।
দেখবেন, সে এর কাছাকাছি জবাব দেবে, ভাই আমার! তোমার স্ত্রী শুধু স্ত্রী নয়। সে তোমার সন্তুনের মা দাম্পত্য জীবনে কেউ সমস্যামুক্ত নয়। তুমি সবসময় ধৈর্য ধরো। তার ত্রুটিগুলো সহজভাবে গ্রহণ করো। আর যাই রেহাক সে তোমার অর্ধাঙ্গিনী, তোমার জীবনসঙ্গিনী কীভাবে মানুষের স্বভাব তার সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব ফেলে। এ কারণেই রাসূল (সা.) পিপাসার্ত, ক্ষুধার্ত বা প্রাকৃতিক প্রয়োজনের প্রবল চাপের সময় বিচারককে কোনো রায় প্রদান করতে নিষেধ করেন।
কেননা, এটা তার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। সব সময় প্রাচীনকালে কোনো এক সম্প্রদায়ে দুর্ধর্ষ এক খুনী বাস করতো। এই রক্তপিপাসু এক-দুজন বা দশ-বিশজনকে নয়, নিরানব্বইজন ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল এটা ঠিক, সে যুগে কীভাবে সে লোকদের প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতো। হয় সে খুব ভয়ঙ্কর প্রকৃতির ছিল; যে কারণে কেউ তার পাশে যেতেই সাহস করতো না, না হয় সে দুর্গম কোনো পাহাড়-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতো।
কেউ তাকে খুঁজে পেতো না। বাস্তবতা যাই হোক, সে হত্যা করেছিল নিরানব্বইটি তাজা প্রাণ। যদি একবার তার মন তওবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো। সে তখন সে যুগের সব থেকে বিখ্যাত আলেমের সন্ধান করতে শুরু করেন। তার হাতে হাত রেখে তওবা করে সে তার কলুশিত জীবন থেকে ফিরে আসবে। লোকেরা তাকে বলল, অমুক উপাসনালয়ে একজন বিখ্যাত আবিদ থাকেন। তিনি এক মুহূর্তের জন্যেও মুসল্লা ছেড়ে কোথাও যান না। তার দিন-রাত কাটে রোনাজারী আর দোয়ায়।
বড় কোমল স্বভাবের, আবেগপ্রবণ এক ব্যক্তি তিনি। তুমি তার কাছে একবার যেতে পারো। সেই খুনি লোকটি সাথে সেঙ্গ সেই পুণ্যবান লোকটির উপাসনালয়ে উপস্থিত হলো ও ভূমিকা ছাড়া সরাসরি বলল, আমি নিরানব্বইজনকে হত্যা করেছি। আমার কি পাপ মোচনের কোনো উপায় আছে? তখন সে আবিদ এতটা নরম স্বভাবের ছিল, আমার মনে হয়, তার মাধ্যমে অনিচ্ছায়ও যদি একটি পিঁপড়া মারা যায় তাহলে তার বাকি দিন অনুশোচনা ও ক্রন্দনেই কেটে যায়। তাহলে যে ব্যক্তি নিরানব্বই জন নিরপরাধ বনী আদমকে হত্যা করেছে, তার সম্পর্কে তার মনোভাব কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়।
আবিদের মনে হলো, যেন নিরানব্বইটা যিন্দা লাশ তার সামনে এ খুনীর রূপ ধারণ করে এসে দাঁড়িয়েছে। আবিদ লোকটি চিৎকার করে বলে উঠলো, না! তোর তওবার কোনো সুযোগ নেই। কোনো সুযোগ নেই। সিমীত জ্ঞানের অধিকারী আবিদের কাছ থেকে এ জাতীয় জবাব আসাটা আশ্চর্যের কিছু নয়। কারণ তার সিদ্ধান্তদান আবেগনির্ভর, জ্ঞান ও চিন্তানির্ভর নয়। তখন পাষ- হৃদয়ের খুনী লোকটি এরকম হতাশাজনক উত্তর শুনে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে যায়। তার দু’চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করল।
সাথে সাথে মসে তার ছুরি দিয়ে আবিদ লোকটিকে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে শুরু করে। ধারালো ছুরির আঘাতে আঘাতে লোকটির দেহ যখন টুকরো টুকরো হয়ে যায় তখন সে উপাসনালয় থেকে বের হয়ে এলো। এভাবেই কেটে যায় আরো কিছু দিন।
আবার তার মন তওবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো। সে আবার বড় কোনো আলিমের সন্ধান করতে শুরু করে। লোকেরা এবার তাকে একজন বিখ্যাত আলেমের সন্ধান দিলো। সেও তৎক্ষণাৎ তাদের নিকট হাজির হলো। এবার লোকটি যার কাছে এসেছে, তিনি অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। চেহারায় গভীর প্রজ্ঞা ও তাকওয়ার ছাপ। খুনী লোকটি তাকে দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলল, আমি একশতজনকে হত্যা করেছি। এখন আমি কি তাওবা করতে পারবো?
তখন সে আলিম সাথে সাথে বলেন, সবহানাল্লাহ! তওবা করতে তোমায় কে বাধা দিচ্ছে? কত সুন্দর জবাব! আসলেই, তাওবা করার পথে তার কোনো বাধা নেই। মহান পরাক্রমশালী স্রষ্টার সামনে তারই বান্দা নত হবে, তার দিকে ফিরে যাবে, কার সাধ্য আছে সে পথে বাধা দেয়ার? লোকটি এমন একজন আলিমের সান্নিধ্যে এসেছিল, যিনি সিদ্ধান্ত দিতেন ইলম ও শরীয়তের ওপর ভিত্তি করে। সিদ্ধান্তদানের ক্ষেত্রে তিনি নিজের স্বভাব-অভ্যাস ও আবেগ-অনুভূতি দ্বারা প্রভাবিত হতেন না।
এমন পরিস্থিতিতে তিনি লোকটিকে বললেন, তুমি যে এলাকায় থাকো, সে এলাকাটি ভালো নয়। আশ্চর্য হওয়ার বিষয় হলো, কীভাবে তিনি বুঝতে পারলেন, সে এলাকাটা ভালো নয়? মূলত তিনি লোকটির অপরাধের পরিমাণ অনুমান করে এটা বলেন। কারণ, যেখানে এত বড় অপরাধ করলেও তেমন একটা বাধা-বিপত্তি পোহাতে হয় না সেখানে নিশ্চয়ই অপরাধ বেশি হয়। তিনি বুঝতে পেরেছেন, লোকটি যে এলাকায় থাকে সেখানে যুলুম-অত্যাচার, হত্যা-হানাহানি এত বেশি, মযলুমের পক্ষ নিয়ে রুখে দাঁড়ানোর মত কেউ নেই।
তিনি তাকে বলেন, তুমি যে এলাকায় থাকো, সেখানে পাপাচার বেশি হয়। তুমি তাছাড়া অমুক শহর বা অমুক শহরে চলে যাও। কারণ, সেখানকার লোকের ইবাদতগুযার ও মুত্তাকি। তুমি তাদের সোহবতে থেকে নির্বিঘ্নে ইবাদত করতে পারবে।
লোকটি তখনই সাচ্চা তাওবা করে নির্দেশিত শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। সে। আজাবের ফিরেশতারা বলেন, সে কখনো কোনো সাওয়াবের কাজই করেনি। যখন ফেরেশতারা এ নিয়ে মতপার্থক্য করে, মীমাংসার জন্য আল্লাহ তা’য়ালা মানুষের আকৃতিতে একজন ফিরেশতা পাঠালেন। তিনি এসে ফয়সালা দিলেন, পুণ্যময় নগরী ও তার নিজের শহরের মাঝে কতটুকু দূরত্ব তা নির্ণয় করতে হবে। সে যে শহরের নিকটবর্তী হবে, তার ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। –
মহান আল্লাহ তা’য়ালা তখন পবিত্র নগরীকে কাছে চলে আসার আদেশ করেন, অপরাধের শহরকে বলেন দূরে সরে যেতে। ফিরেশতারা মেপে দেখেন, লোকটি পুণ্যময় নগরীর অধিক কাছাকাছি। তখন তাকে রহমতের ফিরেশতাদের দায়িত্বে অর্পণ করা হলো। বর্তমানে মুফতীদের মধ্যেও অনেককে দেখা যায়, তারা অনেক সময় আবেগতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা হচ্ছে, আমার এক প্রতিবেশী ছিল। প্রায় প্রতিদিনই স্ত্রীর সাথে তার ঝগড়া হতো।
একবার ঝগড়ার চরম পর্যায়ে সে স্ত্রীকে এক তালাক দিয়ে বসলো। পরবর্তীতে সে রাজআতের মাধ্যমে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিলো। কিছুদিন পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো ও সে একইভাবে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিলো। তার নিকট যখন আমার দেখা হতো, সতর্ক করতাম, তাকে বোঝাতাম। তাকে বারবার তার ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিতাম। একটি কথা আমি তাকে প্রায়াই বলতাম, দেখো, তোমার হাতে শুধু একটা তালাক আছে।
এটা যদি কখনো দিয়ে দাও তাহলে তোমার স্ত্রীকে আর স্বাভাবিকভাবে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। তার আরেক জনের সাথে কিয়ে হতে হবে। তারপর সে স্বামী যদি তালাক দেয় তবেই তুমি তাকে বিয়ে করতে পারবে। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো। নিজের সংসার ভেঙ্গো না। কিছুদিন পর হঠাৎ একবার সে আমার কাছে এলো। তার চেহারার রঙ ফ্যাকাশে। সে কম্পিত স্বরে বলল, হে রাসূল! আমার আবার তার নিকট ঝগড়া হয়েছে ও একপর্যায়ে আমি তাকে তৃতীয় তালাকটিও দিয়ে ফেলেছি।
তার এ কথায় আমি তেমন আশ্চর্য হইনি। আশ্চর্য হলাম পরবর্তী কথায়। সে বলল, আপনি কি কোনো নরম মনের মুফতি সাহেবকে চেনেন, যে আমাকে ফতোয়া দেবে, আমি আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারবো। এমনিভাবে তার এ কথায় আমি বেশ হতবাক হয়ে বিষয়টি নিয়ে একটু চিন্তা করলাম। একটু আগে যে বিষয়টি উল্লেখ করেছি, সেটাই তখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। আমি খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম, অনেক সময় মানুষের মতামত এমনকি তাদের ফিকহী সিদ্ধান্তেরও পরিবর্তন ঘটে নিজস্ব আবেগ ও স্বভাব দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণে।
এই মানুষ যারা স্বভাবিগতভাবেই সম্পদের প্রতি প্রথাকোপারীর তাই সে যদি درد কিন্তু মানুষ মাশালী মানুষের পেছনে ঘুরঘুর করতে থাড়ে দের সম্পদ অর্জন সর্বদা সময়ে নিজের সন্তানদের খোঁজ-খবর নেয়াটাকেই সন্দের লোহলে এটা করতে বিকোনো বিষয় নয়। কারণ, সে স্বভাবগতভাবেই গ্রহণেও লোভী। তার জাত এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণেও এই স্বভাবের যদি আপনি তার নিকট কোনো লেনদেন করতে চান বা তার থেকে কিছু আদায় প্রভাব থাকবে।
করে নিতে চান তাহলে তার নিকট কথা বলার আগে সবসময় এ বিষয়টি মাথায় কাষবেন, লোকটি সম্পদপাগল। তার থেকে আপনার উদ্দেশ্য হাসিলের সময় লক্ষ রাখুন, তার সম্পদের ওপর যেন কোনো চাপ না পড়ে। কোনো বিষয় সুন্দরভাবে বোঝার জন্য উদাহরণ হলো সর্বোত্তম মাধ্যম। এজন্য এখানে একটি উদাহরণ পেশ করছি। আপনি কোনো কাজে একবার হাসপাতালে গেলেন। হঠাৎ এক পুরনো বন্ধুর সাথে আপনার দেখা হয়ে গেলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনারা একসাথে পড়াশোনা করেন। আপনি তাকে পরদিন সকালে নাস্তার দাওয়াত দিলেন। আর সেও আপনার বাড়িতে আসতে রাজি হলো। আপনি বাজারে গিয়ে কিছু দরকারী জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরে আগামীকালের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এ উপলক্ষে ফোনে আপনি আরো কিছু বন্ধুকে দাওয়াত দিলেন, যাতে সবার সাথে আপনার এ বন্ধুটির দেখা হয়ে যায়। যে আপনার আমন্ত্রিত বন্ধুদের মধ্যে এক বন্ধু কৃপণ স্বভাবের। সম্পদের প্রতি তার প্রচ- আসক্তি।
তখন দেখবেন, তাকে যখন আপনি ফোন করে দাওয়াত গ্রহণ করার জন্য বলবেন, সে বলবে আহা! আমার কী দুর্ভাগ্য! আমি যদি ওর সাথে দেখা করতে পারতাম! হে ভাই! কী বলবো বলুন, আমি খুব জরুরী একটা কাজে আটকা পড়ে গেছি। আপনি ওকে আমার সালাম জানাবেন। সম্ভব হলে আমি ওর সাথে পরে দেখা করে নেবো। আপনি যদি তার কৃপণতার কথা আগে থেকে জেনে থাকেন তাহলে তার না আসার কারণও আপনি ধরতে পারবেন।
মূলত সে ভয় পাচ্ছে, যদি সে এ বন্ধুর সাথে দেখা করে তাহলে সৌজন্যের খাতিরে তাকে নিজের বাড়িতেও খাবারের দাওয়াত দিতে হবে এবং সেজন্য তাকে বেশ টাকা খরচ করতে হবে, যেটা তার স্বভাব বিরুদ্ধ একটি বিষয়। তার সার্বক্ষণিক ধান্দা হলো সম্পদ অর্জন করা, খরচ করা নয়। তখন যদি আপনি তাকে জানান, আপনার বিশেষ অতিথির হাতে একদম সময় নেই। সে নাস্তা করেই চলে যাবে। অন্য শহরে তার বিশেষ কাজ আছে তাহলে দেখবেন, সে বলবে, ঠিক আছে। তাহলে আমি এখনই আসছি। কাজটা না হয় পরেই করব।
আপনার চারপাশে এমন অনেককে পাবেন, যারা ঘরকুনো স্বভাবের। পরিবারই তার কাছে সবকিছু। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া তার জন্য প্রায় অসম্ভব। নিজের সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ছাড়া আর যা কিছু তাকে করতে বলবেন, সে মানতে প্রস্তুত। আপনার উচিত হলো যেটা তার জন্য করা অসম্ভব, সেটার জন্য তাকো জোর-জবরদস্তি না করা। এছাড়াও পৃথিবীতে বহু স্বভাবের মানুষ আছে। এখানে সব থেকে আকর্ষণীয় ব্যক্তি সে, যে মানুষের মন জয়ের পদ্ধতি আয়ত্ত্ব করতে পেরেছে।
সফরসাথী কৃপণ হলে সেও খরচে মিতব্যয়ী হয়ে যায়। ফলে কৃপণও তাকে পছন্দ করে। আবেগ-প্রবণ ব্যক্তির কাছে গেলে তার আবেগেও ঢেউ ওঠে। ফলে আবেগী ব্যক্তিও তাকে ভালোবাসে। যারা রসিকতা পছন্দ করে তাদের সাথে দেখা হলে সে হালকা রসিকতা করে। এজন্য তাদের কাছেও সে কাঙ্ক্ষিত সাথী। সকল অবস্থায় আপনি অবস্থা উপযোগী পোশাক ধারণ করুন। চাই সেটা দুঃখের হোক বা আনন্দের। তাহলে এবার আপনি আসুন, আমরা একটু স্মৃতিচারণ করি। ফিরে যাই নববী যুগে।
একদিন রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। মক্কায় প্রবেশের পূর্বে মক্কার লিডার আবু সুফিয়ান রাসূল (সা.)-এর নিকট এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। ঘটনা বেশ দীর্ঘ। আবু সুফিয়ানের ইসলাম গ্রহণের পর আব্বাস (রা.), রাসূল (সা.)-কে বলেন, আবু সুফিয়ান নিজের বড়ত্ব প্রকাশ করতে ভালোবাসে। তার বড়ত্ব প্রকাশের ন্যয় কোনো সুযোগ করে দিন। তখন রাসূল (সা.) মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ।
যে ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখবে, সেও নিরাপদ। আর যে মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে, সেও নিরাপদ। আবু সুফিয়ান যখন মক্কায় ফিরে যেতে উদ্যত হলেন, রাসূল (সা.) তার দিকে তাকালেন। এই সেই আবু সুফিয়ান, যে কুরাইশ গোত্রকে বদর প্রান্তরে যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ওহুদ ও খন্দকের যুদ্ধেও সেই বিশাল সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিল, সকলেকে মুসলমানদেগর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্ররোচিত করেছিল। এ সেই সেনাপতি, বহু যুদ্ধের সাহসী যোদ্ধা। যুদ্ধের ময়দানে ঘোড়া হাঁকিয়ে কেটেছে তার জীবন। সবেমাত্র তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এ কারণে রাসূল (সা.) তাকে ইসলামের শক্তিমত্তা দেখাতে চাইলেন। রাসূল (সা.) আব্বাস (রা.)-কে ডাকলেন। আব্বাস (রা.) সাথে সাথে উত্তর দিলেন, হে রাসূল। আমি উপস্থিত।
রাসূল (সা.) বলেন, মুসলিম বাহিনী যখন মক্কায় প্রবেশ করবে তখন প্রবেশপথে যে সরু গিরিপথটি আছে সেখানে আপনি আবু সুফিয়ানকে নিয়ে দাঁড়াবেন। আব্বাস (রা.) আবু সুফিয়ানকে নিয়ে নির্দেশিত স্থানে দাঁড়ালেন। মরুভূমিতে ধূলঝড়ি তুলে সেখান দিয়ে মুসলিম বাহিনী এগিয়ে চলছিল মক্কা অভিমুখে। সকল দলে অগ্রে ছিল একটি করে পতাকা। প্রথম সৈন্যদলটি যখন অতিক্রম করল, আবু সুফিয়ান (রা.) বলেন, আব্বাস! এরা কারা? আব্বাস (রা.) বলেন, এরা সুলাইম গোত্রের লোক।
আবু সুফিয়ান বলেন, সুলাইমের সাথে আমার কী সম্পর্ক! তারপর দ্বিতীয় সৈন্যদলটি অতিক্রম করল। আবু সুফিয়ান (রা.) বলেন, এরা কারা? আর এদিকে আব্বাস (রা.) বলেন, এরা মাযীনা গোত্রের লোক। আবু সুফিয়ান বলেন, মাযানী গোত্রের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এভাবে একের পর এক সবকটি দল চলে যায়। সকলটি দল যাওয়ার সময় আবু সুফিয়ান (রা.) তাদের পরিচয় জানতে চাচ্ছিলেন আব্বাস (রা.) যখন পরিচয় দিচ্ছিলেন, তিনি বলছিলেন, আমার এ গোত্রের সম্পর্কে কোনো মাথাব্যথা নেই।
তারপর যখন শেষ মুহুর্তে যে সৈন্যদলটি অতিক্রম করল তাদের পতাকা ছিল সবুজ বর্ণের। তাদের শরীর ছিল লৌহবর্মে আবৃত। বর্মের ফাঁক দিয়ে শুধু তাদের চোখদুটোই দেখা যাচ্ছিলো। এ সৈন্যদলটি ছিল মুহাজির ও আনসারদের যার নেতৃত্বে ছিলন স্বয়ং রাসূল (সা.)। আবু সুফিয়ান এ দলটি দেখে বলেন, সবহানাল্লাহ! আব্বাস এটা কোন সৈন্যদল?
আব্বাস (রা.) আরো বলেন, এটা হলো রাসূল (সা.)-এর নেতৃত্বে আনসার। মুহাজির সাহাবায়ে কেরামের দ্বারা গঠিত সৈন্যদল। আবু সুফিয়ান দীপ্ত কণ্ঠে বলেন, এতে রক্তিম মৃত্যুর ছদ্মাবেশ। খোদার কসম। এদের সাথে মোকাবেলা করার সাধ্য কারো নেই। হে আবুল ফযল। আব্বাসে (রা.)-এর উপনাম তোমার ভাতুষ্পুত্র বিশাল রাজত্বের অধিকারী হয়েছে। আব্বাস (রা.) বলেন, আবু সুফিয়ান। এটা রাজত্ব নয় এটা হলো নবুওয়ত। আবু সুফিয়ান বলেন না, সেটাই বলছি।
যখন গোটা সৈন্যবাহিনী তাদেররে অতিক্রম করে চলে যায় তখন আব্বাস (রা.) আবু সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলেন, আবু সুফিয়ান। তোমার কওমকে বাঁচাও। আবু সুফিয়ান দ্রুত মক্কায় চলে গেলেন ও উচ্চ স্বরে ঘোষণা করতে শুরু করে হে কুরাইশ সম্প্রদায়। মুহাম্মাদ (সা.) তোমাদের দোরগোড়ায় উপস্থিত। তা নিকট মোকাবেলা করার সাধ্য তোমাদের কারো নেই। যে আমার ঘরে অত্য নেবে, সে নিরাপদ। এভাবে তারা বলতে থাকলো, খোদা তামার ধ্বংস করুক। তোমার ঘরে কী সবার জায়গা হবে?
আবু সুফিয়ান বলেন, যে ব্যক্তি নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে সেও নিরাপদ। যে মসজিদে হারামে আশ্রয় নেবে সেও নিরাপদ। তখন লোকেরা কেউ ঘরে আর কেউ মসজিদে আশ্রয় নিলো। ২ আল্লাহু আকবার! রাসূল (সা.)-এর কি অপূর্ব বিচক্ষণতা! কী অভিনব কৌশল তিনি আবু সুফিয়ান (রা.)-এর মন জয় করে নিলেন। আর তার ওপর রাসূল (সা.) যে পন্থাটি প্রয়োগ করেছিলেন, সেটিই ছিল তাকে কাবু করার সব থেকে উপযোগী পন্থা।
এ প্রসাথে তাৎপর্যপূর্ণ একটি কথা হলো, আপনি কারো সাথে কথা বলার পূর্বেই তার স্বভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অবগত হবেন। আপনি যদি তার স্বভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির সম্পর্কে অবগত থাকেন তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন, তার নিকট কেমন আচরণ করতে হবে, কীভাবে কথা বলতে হবে। গাযওয়ায়ে হুদাইবিয়া। রাসূল (সা.) বায়তুল্লাহ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মুহাজির ও আনসার সাহাবায়ে কেরামের নিয়ে বের হয়েছেন। সাথে যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন — আরব কবীলার অনেকেই।
সব মিলিয়ে কাফেলার সদস্যসংখ্যা চৌদ্দশত। * প্রত্যেকে ইহরাম বেঁধে কুরবানীর পশু সাথে করে এনেছেন, যাতে সবার কাছে ১৭ স্পষ্ট হয়ে যায়, তারা শুধু বাইতুল্লাহ যিয়ারতের জন্যেই বের হয়েছেন। রাসূল ? (সা.) যখন মক্কার উপকণ্ঠে পৌঁছুলেন, কুরাইশরা তাদেরকে মক্কায় প্রবেশ ন করতে বাধা দিলো। রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামের নিয়ে হুদাইবিয়া নামক স্থানে অবস্থান করেন। ও কুরাইশরা সমঝোতার আসার জন্য রাসূল (সা.)-এর নিকট একের পর এক প্রতিনিধি পাঠাতে শুরু করেন।
সর্বপ্রথম তারা মিকরায বিন হাফসকে পাঠালো। মিকরায কুরাইশ গোত্রের লোক হলেও ওয়াদা-অঙ্গীকার রক্ষার ক্ষেত্রে নড়বড়ে ছিল। সে ছিল দুরাচার ও ধূর্ত স্বভাবের লোক। রাসূল (সা.) তাকে আসতে দেখেই বলেন, এ লোকটি ধোকাবাজ। যদি যখন সে কাছে এসে পৌঁছলো, রাসূল (সা.) তার উপযোগী কথাই তাকে বলেন, আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি। আমরা শুধুমাত্র উমর পালন করার জন্য এসেছি। এক যে এটা ঠিক, তার নিকট রাসূল (সা.) কোনো রকমের ওয়াদা-অঙ্গীকার করেন না।
কারণ তিনি জানতেন, সে এর উপযুক্ত নয়। তখন কোনো সমঝোতা ছাড়াই মিকরায কুরাইশদের কাছে ফিরে যায়। মিকরাযের পর কুরাইশরা আহাবিশ গোত্রের লিডার হুলাইস বিন আলকামাকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠালো। আহাবিশ ছিল এমন এক গোত্র, যারা হারামের সম্মানার্থে মক্কায় অবস্থান করতো এবং কাবাঘরের দেখাশোনা করতো। রাসূল (সা.) তাকে আসতে দেখে বলেন, ইনি এমন গোত্রের লোক যারা খুব ইবাদতগুযার। তাই তোমরা নিজেদের কুরবানীর পশুগুলোকে সামনে নিয়ে এসো, যাতে আগন্তুক সেগুলো দেখতে পায়।
যখন হুলাইস দেখলো, কুরবানীর জন্য প্রস্তুত অসংখ্য পশু উপত্যকার মাঝে চরে বেড়াচ্ছে, যেগুলোকে হারাবে যবাই করার জন্য নিয়ে আসা হয়েছে তখন সে আর সামনে বাড়তে পারলো না। রাসূল (সা.)-এর সাথে দেখা না করেই সে ফিরে যায়। সে যা দেখেছে, সেটাই তার কাছে অনেক কিছু। উমরা করতে ফিরে মানুষদেরকে বাইতুল হারাম থেকে বাধা দেয়ার স্পর্ধা তার নেই। সে কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে বিষয়টি জানালো। কুরাইশ নেতারা সব শুনে বলল, তুমি চুপ করে বসে থাকো।
তুমি বেদুঈন। এসব বিষয় তুমি বুঝবে না। এমন অপমানজনক কথায় হুলাইস খুব রেগে যায়। সে বলল, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমার শুনে রাখো, এমন হীন বিষয়ে তোমাদের সাথে আমাদের কোনো চুক্তি হয়নি। বাইতুল্লাহকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য যে যিয়ারত করতে আসবে, তাকে কেন বাধা দেয়া হবে? আমার জান যার হাতে সেই সত্তার কসম! মুহাম্মাদকে উমর (রা.) করার জন্য পথ উন্মুক্ত করে দাও। নইলে আমি আমার গোত্রের সকলেকে নিয়ে এই স্থান ত্যাগ করব।
তখন কুরাইশরা বলল, তুমি শান্ত হও। আমাদের সমস্যাটা আমাদেরকেই সমাধান করতে দাও। এ পর্যায়ে তারা এমন কাউকে প্রতিনিধি করে পাঠাতে চাইলো যে খুব সম্ভ্রান্ত। তারা উরওয়া বিন মাসউদ সাকাফীকে নির্বাচন করল। উরওয়া বলল, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি দেখেছি, ইতিপূর্বে যারাই মুহাম্মাদ (সা.)-এর নিকট যাওয়ার পর আপনাদের কাছে ফিরে এসেছে, তারাই আপনাদের তিরস্কার ও ধিক্কারের পাত্র হয়েছে। আপনারা জানেন, আমি পুত্র সমতুল্য ও আপনারা পিতৃসমতুল্য।
কুরাইশ নেতারা বলল, তুমি সত্য বলেছো তুমি আমাদের পক্ষ থেকে কোনো তিরস্কারের সম্মুখীন হবে না। তখন উরওয়া নিজ গোত্রের লিডার ছিল। স্বগোত্রে যেমন ছিল তার সম্মান, তেমনই ছিল তার প্রতিপত্তি। মানুষের মাঝে তার শ্রেত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল। উরওয়া রাসূল (সা.)-এর নিকট পৌঁছে একেবারে রাসূল (সা.)-এর সামনে বসলো। একবার সে রাসূল (সা.)-কে বলল, মুহাম্মাদ! তুমি নিচু শ্রেণির কিছু মানুষ একত্রিত করেছো। তাদেরকে নিয়েই এসে পড়লে মক্কাভূমি বিজয় করতে?
আর শুনে রাখো, এরা হলো কুরাইশ। এদের সাথে আছে বিরাট সৈন্যদল। সকলে আজ সিংহের বেশে ময়দানে। তারা আল্লাহর নামে অঙ্গীকারাবদ্ধ। জবরদর্তি করে কিছুতেই তুমি মক্কায় প্রবেশ করতে পারবে না। আল্লাহর শপথ! আগামীকাল তারা তোমাদের নাস্তানাবুদ করে কাপড়ই খুলে ফেলবে। হায় আমি যদি তখন তাদের সাথে থাকতে পারতাম! আবু বকর (রা.) রাসূল (সা.) পিছনে দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি বলেন, তুই তোর প্রভু লাতের কাছে। আমরা কি তার কাপড় ধরে টানছি?!
তাদের এ ধরণের উত্তর শুনে সাকাফী গোত্রপ্রধান লা-জওয়াব হয়ে যায়। এমন উত্তর শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। বাস্তবিকপক্ষে সে কিছু শোনারই উপযুক্ত ছিল। মুগুর ঠিকমত পড়লেই না ঘাড় থেকে অহঙ্কারের ভূত নামে।। উরওয়া প্রভাবিত হয়ে বলল, মুহাম্মাদ! এ কে? রাসূল (সা.) বলেন, ইনি আবু কোহাফের পুত্র। উরওয়া বলল, আল্লাহর শপথ! আমার ওপর যদি তোমার কিছু আনুগ্রহ না থাকতো, তবে আজ এর বদলা নিয়ে নিতাম। আহকের অপমানে শোধ হয়ে যায় সেই অনুগ্রহের ঋণ!
ঐ অবস্থা থেকে উরওয়া নরম স্বরে কথা বলতে শুরু করে। সে কথা বলার সময় বারবার হাত দ্বারা রাসূল (সা.)-এর দাড়ি মোবারক স্পর্শ করছিল। মুগিরা বিন শোবা সাকাফী (রা.) রাসূল (সা.)-এর পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার মুখ লোহার শিরস্ত্রাণে আবৃত ছিল। যখন উরওয়া রাসূল (সা.)-এর দড়ির দিকে হাত বাড়াচ্ছিলো, মুগিরা (রা.) তলোয়ারের প্রান্ত দ্বারা তার হাতে খোঁচা দিচ্ছিলেন। উরওয়া যখন দ্বিতীয়বার হাত বাড়ালো, মুগিরা (রা.) তলোয়ার দ্বারা তা সরিয়ে দিলেন।
তৃতীয়বার সে হাত বাড়ালে মুগিরা (রা.) বলেন, কবজি বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্বেই রাসূল মুখের কাছ থেকে হাত সরিয়ে নাও। উরওয়া চমকে উঠে বলল, তোমার ধ্বংস হোক! কত বড় বেয়াদব! মুহাম্মদ! এ কে? রাসূল (সা.) মুচকি হেসে বলেন, এ তোমার ভাতিজা মুগিরা বিন শোবা সাকাফী। উরওয়া বলল, আরে নিমকহারাম! এই সেদিন তোর পায়খানা-পেশাব পরিস্কার করলাম!। উরওয়া উঠে দাঁড়ালো ও কুরাইশদের কাছে ফিরে এসে রাসূল (সা.) যা বলেন তা জানালো।
সে বলল, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! খোদার কসম! আমি পারস্যের সম্রাটকে দেখেছি, রোমের সাম্রাটকেও দেখেছি ও আবিসিনিয়ার সম্রাটকেও। আল্লাহর শপথ! আমি কোনো বাদশাহর অনুচরদেরকে তাকে এতটুকু সম্মান করতে দেখিনি, যতটুকু মুহাম্মাদকে তার সহচরগণ করে থাকে। এ কথা শুনে কুরাইশদের মনে রাসূল (সা.) সম্পর্কে এক শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় ঢুকে যায়, যা ইতিপূর্বে তাদের মধ্যে ছিল না। তখন তারা সুহাইল বিন আমরকে রাসূল (সা.)-এর নিকট পাঠালো।
রাসূল (সা.) তাকে দেখে সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে বলেন, এবার তোমাদের বিষয়টা সহজে নিষ্পত্তি হবে। তারপরই দু’দলের মধ্যে হুদাইবিয়ার সন্ধিপত্র লিখিত হলো। আর তাহলো রাসূল (সা.) মানুষ চেনার দক্ষতা এবং প্রত্যেকের সাথে তাদের উপযুক্ত চাবি ব্যবহার করে আচরণ করার কৌশল। মানুষ বিভিন্ন প্রকারের হওয়া তাদের স্বভাবগত একটি বৈশিষ্ট্য। তাদের সাথে কথাবার্তা বা অন্য কোনো কাজ করতে গিয়ে আপনি এটা উপলব্ধি করতে পারবেন।
ইচ্ছা করলে আপনি নিজেই বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। যেমন- কোনো মজলিসে আপনি একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা বলুন। তারপর মানুষের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করুন। আমি একবার এক মাহফিলে উমর (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা বর্ণনা করি। অগ্নিপূজক আবু লুলু কর্তৃক উমর (রা.)-কে ছুরিকাঘাত করার সাথে যখন পৌঁছলাম তখন একটু উঁচু স্বরে বললাম, হঠাৎ আবু লুলু মিহরাবের আড়াল থেকে বের হয়ে এসে উমর (রা.)-কে খঞ্জর দ্বারা তিন তিনটি আঘাত করল।
প্রথম আঘাত তার বুকে শুরু করে। দ্বিতীয়টি পেটে। তারপর আবু লুলু শরীরের সর্বশক্তি একত্রিত করে তৃতীয় আঘাতটি করল তার নাভীমূলে। তারপর খঞ্জর টান দিলে তার পাকস্থলী বের হয়ে এলো। আমি এই ঘটনা বলার সময় মানুষের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছিলাম। কাউকে এ ঘটনা শুনে চোখ বন্ধ করে ফেলতে দেখলাম। যেন সে এ মর্মান্তিক দৃশ্যটি স্বচক্ষে দেখছে। কেউ কেউ এ ঘটনা শুনে কেঁদে ফেললো। কিছু কিছু লোকরে দেখলাম, নির্বিকার ভাবে শুনে যাচ্ছে। তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই।
যেন ঘুমানোর পূর্বে কোনো গল্প শুনছে! আপনি সকল শহীদের লিডার, রাসূল (সা.)-এর সিংহ হামযা (রা.)-এর ঘটনা বর্ণনা করুন; কীভাবে তিনি ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হলেন, কীভাবে তার পেট কেটে কলিজা বের করে নেয়া হলো, কীভাবে তার নাক-কান কাটা হলো। তারপর দেখুন মানুষের প্রতিক্রিয়া। এককথায় জীবন থেকে আমি এ শিক্ষা পেয়েছি, সকল সমাজেই এমন কিছু মানুষ নিঃসন্দেহে আছে যারা স্বভাবে রুক্ষ, যেভাবে কথা বলা উচিত সেভাবে বলে না এবং শ্রোতার সামনে সৌজন্য রক্ষার প্রয়োজন বোধ করে না।
এ ধরনের এক ব্যক্তি কয়েকজনের সাথে বসে কোনো এক বিক্রেতার নিকট ঘটে যাওয়া ঘটনা বলছিল। কথা সাথে সে বলল, সেই বিক্রেতাটা গাধার মত মোটা। একদম এ খালিদের ন্যয়। সে তার পাশে বসে থাকা এক ব্যক্তির দিকে ইশারা করল। দেখতে লোকটা কীভাবে আমি কোনোভাবে বুঝলাম না, একদম গাধার ন্যায় অবিকল খালিদের মতো হলো?
আলোচনা শেষ করার পূর্বে একটি বড় প্রশ্ন থেকে যায়। সেটা হলো মানুষের সঙ্গ সামঞ্জস্য রেখে চলতে গিয়ে কি নিজের স্বভাব পরিবর্তন করা সম্ভব? উত্তর হলো, হ্যাঁ। নিঃসন্দেহে সম্ভব। উমর (রা.) শাসন ও কঠোরতার ক্ষেত্রে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন। তার খেলাফতকালে এক ব্যক্তির নিজ স্ত্রীর সাথে ঝগড়া হলো। সে ওমরের কাছে জানতে চান যে তার স্ত্রীর সাথে এখন সে কী আচরণ করবে?
তারপর উমর (রা.)-এর বাড়ির সামনে এসে দরজায় টোকা দিতে যাবে, এমন সময় সে শুনতে পেলো, ওমরের স্ত্রী উচ্চ স্বরে তাকে বকাঝকা করছে, তখন উমর (রা.) নীরবে স্ত্রীর বকাবকি শুনে যাচ্ছেন। না তার কথার উত্তর দিচ্ছেন, না তাকে প্রহার করেন। এরপর লোকটি উমর (রা.)-কে না ডেকে দরজা থেকেই ফিরে যায়। যে উমর মতো কঠোর, স্ত্রীর সাথে তার এমন ভূমিকা দেখে সে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল। উমর (রা.) দরজার শব্দ অনুভব করতে পেরে বের হয়ে এলেন ও লোকটিকে ডেকে বলেন, কী ব্যাপার? লোকটি বলল, হে আমিরুল মুমিনীন! আমি আপনার কাছে আমার স্ত্রীর সম্পর্কে অভিযোগ করতে এসেছিলাম।
এসে শুনলাম আপনার স্ত্রী আপনাকে বকাবকি করছে! এর জবাবে উমর (রা.) বলেন, শোনো! সে আমার স্ত্রী! আমার শয্যাসঙ্গিনী। সে আমার রান্না করে দেয়, আমার কাপড় ধুয়ে দেয়, তবুও কি তার সামান্য দুর্ব্যবহার আমি সহ্য করব না? এটা সত্য, কিছু মানুষ কোনো কিছুতেই শোধরায় না। আমাদের উচিত হবে, তাদের সাথে তাল মিলিয়েই চলা। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা আমার অভিযোগ করে এভাবে, তার বাবার অতিরিক্ত রাগের বা স্ত্রীর কৃপণতার প্রসঙ্গে।
আমি তাদেরকে সংশোধনের কিছু পন্থা বলে দিলেও তারা জানায়, সব ধরনের চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। এখন তার সমাধান কী? সমাধান হচ্ছে, তাদের দুর্ব্যবহারের ওপর ধৈর্য ধরতে হবে। তাদের হাজারো ভালো আচরণের কথা স্মরণ করে অল্প কিছু খারাপ আচরণের কথা ভুলে যেতে হবে। যথাসম্ভব তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। এর কারণ কিছু সমস্যা আছে, যার কোনো সমাধান নেই।
ফলাফল:
প্রথম সাক্ষাতেই কোন লোকের সাথে উঠাবসার সময় তার স্বভাব-চরিত্র জেনে নিলে আপনি সহজেই তার হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারবেন।
No Comment! Be the first one.