বর্তমানে অনেক মানুষের আচার আচরণ হয়ে গেছে বাণিজ্যিক ধরণের। তাদের সদাচরণ শুধুমাত্র ধনীদের জন্যেই। ধনীদের সাথে কথা বলার সময় তাদের মুখে হাসি থাকে। ধনীদের শত অপরাধ ও ভুলত্রুটিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে এড়িয়ে চলে। অপরদিকে গরিবের ভুল মারাত্মক। তাদের সাথে আচরণ বড় কঠোর ও অন্যরকম হয়ে থাকে। তারা দরিদ্রদের কথা শুনলে অবজ্ঞাভরে হাসতে থাকে। গরীবরা ছোট- খাটো কোনো অপরাধ করলেও ক্ষমা নেই। শোনামাত্রই শুরু হয়ে যায় তিরস্কার। ঝড় উঠে আলোচনা-সমালোচনার। তাদের ভুল-ত্রুটিগুলো অনেক বড় করে দেখা হয়। দুর্বল কেউ কোনো ভুল করে ফেললে ঘটে যায় তুলকালাম কা-।
নিঃসন্দেহে রাসূল (সা.)-এর ভালোবাসা ও মায়া-মমতা ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের প্রতি ছিল সমান। হাদীসের এক বর্ণনামতে, আনাস (রা.) বলেন, যাহির বিন হারাম নামক এক বেদুঈন সাহাবী কখনো কখনো প্রয়োজনবশত মরু এলাকা থেকে মদিনায় এলে রাসূল (সা.) জন্য পনির বা ঘি হাদিয়া নিয়ে আসতেন। ফিরে যাবার সময় রাসূল (সা.) তাকে খেজুর অন্য কিছু হাদিয়া দিয়ে দিতেন। নবিজী তাকে খুব বেশি ভালোবাসতেন।
তার সম্পর্কে বলতেন- إِنَّ زَاهِرًا بِادِيتُنَا وَنَحْنُ حَاضِرُوهُ
যাহির আমাদের বেদুঈন প্রতিনিধি, আমরা তার শহরের বন্ধু। বিশেষ করে যাহিরের মুখাবয়ব তেমন সুশ্রী ছিল না। তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। একবার তিনি গ্রাম থেকে রাসূল (সা.)-এর কাছে এলেন। তখন নবিজীকে বাড়িতে পেলেন না। তার নিকট কিছু পণ্য ছিল। বিক্রির জন্য সেগুলো নিয়ে তিনি বাজারে চলে গেলেন।
রাসূল (সা.) বাড়ি ফিরে যাহিরের আগমন সংবাদ জানতে পেরে তাকে তালাশের জন্য নিজেই বের হয়ে পড়লেন। বাজারে গিয়ে দেখেন, যাহির (রা.) পণ্য বিক্রি করেন। তার শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। শরীরের কাপড়-চোপড় ঘামে ভিজে আছে। গ্রাম্য লোকদের কাপড়-চোপড়ের ন্যয়ই তার কাপড় থেকে ঘামের গন্ধ আসছে। রাসূল (সা.) তাকে পেছন দিক থেকে দেখেন। তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। যাহির নবিজীকে দেখতে পাননি। তিনি বুঝতে পারলেন না, কে তা এভাবে ধরেছে। যাহির ঘাবড়ে গেলেন এবং বলে উঠলেন, আমাকে ছেড়ে দিন। কে আপনি?
ঐ সময় নবীজী (সা.) নিরব হয়ে যান। তারপর যাহির ছুটার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে গিয়ে হঠাৎ পেছনের দিকে ফিরলেন। নবিজীকে একপলক দেখেই তার হৃদয়-মন প্রশান্ত হয়ে যায়। অন্তরের অস্থিরতা দূর হয়ে গেল। আনন্দে তিনি আত্মহারা হয়ে পড়লেন।
কী আশ্চর্যের বিষয়! ঐ লোক রাসূল (সা.)-কে চিনতে পেরে তিনি নিজ পৃষ্ঠদেশকে রাসূল (সা.) পবিত্র সীনার সাথে মিলিয়ে রাখলেন। নবিজী যাহিরের সাথে একটু রসিকতা করতে চাইলেন। তিনি উচ্চ স্বরে বলতে শুরু করে, এ গোলামটিকে কে কিনবে? কে কিনবে গোলামটিকে?
রাসূল (সা.)-এর কথা শুনে যাহির নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। তিনি দরিদ্র এক গ্রাম্য বেদুঈন। সহায়-সম্বল নেই, অবয়বে সৌন্দর্য বলতে কিছু নেই। নিজেকে বড় নিঃস্ব-অসহায় মনে হলো তার। এদিকে তিনি নবিজীকে বলেন, হে রাসূল! আপনাকে গোলামটা অনেক সস্তায় বিক্রি করতে হবে। রাসূল (সা.) বলেন, তাছাড়া আল্লাহর কাছে তুমি সস্তা নও। মহান আল্লাহর কাছে তুমি অনেক দামী।
এমন মহৎ গুণের অধিকারী, দয়ার আধার, করুণার নবী, রাসূল (সা.)-এর জন্য অসহায় দুঃখীদের মন পাগলপারা থাকবে, রাসূল (সা.) জন্য তারা নিবেদিতপ্রাণ হবে, এতে আশ্চর্যের কী?
এভাবেই রাসূল (সা.) মানুষের মন জয় করেছেন হৃদয়ের গভীর ভালোবাসা দিয়ে। সর্বোৎকৃষ্ট আখলাক নৈপুণ্যতা দিয়ে তিনি মানুষের অন্তর কেড়ে নিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে আপনি লক্ষ্য করে আরো দেখবেন, বহু গরীব মানুষ আছে, যারা ধনীদের কাছে সম্পদ ও মালদৌলতের কৃপণতা নিয়ে অভিযোগ করে না। একবেলা খাবারের জন্য হাত বাড়ান না। তারা ধনীদের কাছে পেতে চান একটু সুন্দর আচরণ, একটু কোমল ব্যবহার। কজন অসহায়-দরিদ্রকে দেখে আপনি মিষ্টি হাসি হেসেছেন? কজনের প্রতি মূল্যায়ন ও সম্মানবোধ প্রকাশ করেন? আপনি জানেন কী, নির্জন রাতের নীরব প্রহরে সে আপনার জন্য মহান আল্লাহর নিকট দোয়া করে? আপনার নিরাপদ ভবিষ্যৎ ও শান্তিময় জীবন কামনা করে? বিশেষ করে তার দো’আর কারণে আপনার প্রতি বর্ষিত হয় আসমানী রহমত?
বিক্ষিপ্ত চুল, ছিন্নবসন পরিহিত, মানুষের দুয়ার থেকে বিতাড়িত এমন অনেক ধুলোমলিন অবয়বের ব্যক্তি রয়েছে, যাদেরকে দুয়ার থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। যারা আল্লাহর নামে শপথ করে কিছু বললে মহান আল্লাহ তা পূর্ণ কবুল করেন। এসব দুর্বল গরীবদের সাথে সর্বদা হাসিমুখে কথা বলুন।
ইঙ্গিতে:
হতে পারে কোনো গরীব অসহায় ব্যক্তির নিকট সামান্য হাসি, মহান আল্লাহর নিকট হতে পারে আপনার মর্যাদা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ।
No Comment! Be the first one.