দুধ, মাছ, মাংস বা এমন কিছু খাবার আছে যা পুষ্টিকর বলে মনে হলেও গর্ভাবস্থায় অনেক সময় মা ও শিশুর জন্য বিপদজনক হতে পারে। গর্ভাবস্থায় খাবেন না এমন কিছু খাবারের বিষয়ে ব্যাখ্যা করব আমি আজকের এই আর্টিকেলটিতে।
এ তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে ব্রিটেনের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে।
কাঁচা বা অপাস্তরিত দুধ
যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন এ গর্ভবতীদের কাঁচা বা অপাস্তরিত দুধ এবং অপাস্তরিত দুধের তৈরি খাবার থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কেননা এতে listeria নামে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। তার কারণে listeriosis infection হতে পারে।
এই ইনফেকশনের ফলে গর্ভপাত বা মৃত সন্তান প্রসবের মতো ভয়াবহ ঝুঁকি থাকে। শিশু জীবিত জন্মালেও তার শারীরিক অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে থাকে। এছাড়া Salmonella, E. coli, Campylobacter এ ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুকিও থাকে। সাধারণত বাজারের প্যাকেটজাত দুধগুলো পাস্তরিত অর্থাৎ বিশেষ প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া মুক্ত হয়ে থাকে।
তবে zoonotic রোগ বিশেষজ্ঞ আইরিন সুলতানার মতে, অনেক প্যাকেটজাতর দুধে পাস্তরিত শব্দটি লেখা থাকলেও এটি নিরাপদ নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি প্যাকেটজাত দুধ বা কাঁচা দুধ, যেটাই হোক না কেন, সেটা অন্তত ১৫ মিনিট ধরে ফুটিয়ে পরে ঠান্ডা অবস্থায় খেতে বলেছেন।
অপাস্তরিত দুধে তৈরি খাবারে রয়েছে পেটা চিজ, ব্রি, শেবরি, এই পনির গুলো গর্ভাবস্থায় না খাওয়াই ভালো।
কাঁচা বা আধা সেদ্ধ মাছ
গর্ভবতী মায়েদের কাঁচা বা আধা সেদ্ধ মাছ খাওয়া এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। সেই হিসেবে সুশি, শামেসি, কাঁচা ঝিনুক, প্লান্ট, মাসেলস, পিজার্ভ করা মাছ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
কেননা কাঁচা ও আধা সেদ্ধ মাছে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবী থাকে। যা মায়ের শরীরে নোরা ভাইরাস, ভিব্রীও, লিস্টেরিয়া, সালমনেলা নামের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
যা থেকে মা ও শিশুর নানা জটিলতা দেখা দেয়। যেমন : মায়ের পানি স্বল্পতা দেখা দিতে পারে এবং মা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এতে গর্বের শিশু সময়ের আগে নানা প্রকারের জটিলতা নিয়ে ভূমিষ্ঠ হতে পারে। এমনকি মৃত সন্তান প্রসবের মতো ঝুঁকিও বেড়ে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতে, গর্ব অবস্থায় কাঁচা মাছ খেলে মায়ের লিস্টেরিয়াই সংক্রমনের আশঙ্কা অন্য সময় তুলনায় ১০গুণ বেড়ে যায়। এদিকে ব্রিটেনের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বড় আকারে সামুদ্রিক মাছ খেতে ও সতর্ক করেছে। এর মধ্যে রয়েছে sal fish, marlin, টুনা মাছ ইত্যাদি।
কেননা এসব মাঝে উচ্চমাত্রার পারদ, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং দূষিত পদার্থ রয়েছে যা অনাগত শিশুর ক্ষতি করতে পারে। তবে বাংলাদেশে এ মাছগুলো খুব বেশি প্রচলিত নয়। আপনি যদি প্রবাসী হন, তাহলে এ পরামর্শ কাজে আসতে পারে। তবে অবশ্যই মাছ ভালো করে ধুয়ে সম্পূর্ণ সেদ্ধ করে খেলে কোন ঝুঁকি নেই।
কাঁচা বা আধা সেদ্ধ মাংস
গর্ভবতী মায়েদের কাঁচা বা আঁধা সেদ্ধ মাংস খাওয়া থেকেও বিরত থাকা পরামর্শ দিয়েছে ব্রিটেনের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। কেননা কাঁচা আধা সেদ্ধ মাংসে toxoplasma, E. coli, listeria নামের প্রচুর ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবী থাকে। মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
আগেই বলেছি, listeriosis infection এর ফলে মায়ের গর্ভপাত বা মৃত সন্তান প্রসব কিংবা নানা জটিলতা নিয়ে শিশুর জন্মানোর ঝুঁকি থাকে। Toxoplasmosis গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া শিশুর স্নায়বিক রোগ, অন্ধত্ব, মৃগী রোগ, সেই সাথে সময়ের আগে শিশুর জন্ম, কম ওজন নিয়ে শিশুর জন্মেও থাকে।
কাঁচা বা আধা সেদ্ধ মাংসের একটি উদাহরণ হতে পারে স্টেক ( Beef Steck ) তবে মাংস ভালো ভাবে ধুয়ে, সম্পূর্ণ সিদ্ধ করে খেলে কোন ঝুঁকি থাকে না।
প্রাণীর কলিজায় এবং কিডনিতে আয়রন ভিটামিন বি ১২, জিংক এবং কপারের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান রয়েছে। যা শিশুর জন্য ভালো। কিন্তু এসব অরগান মিটে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন A রয়েছে, যা অনাগত শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বলে জানিয়েছে ব্রিটেনের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।
এছাড়া বক, রাজহাঁস, কোয়েল বা যে কোন বন্য পশু, পাখি যেগুলো গৃহপালিত বা ফার্মের নয় সেগুলো খাওয়া এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ কিছু কিছু খাদ্যে উচ্চমাত্রায় সোডিয়াম ও চর্বি থাকলে, যা কখনো স্বাস্থ্যকর নয়।
অন্যদিকে জাঙ্ক ফুটে ক্যালরি বেশি কিন্তু পুষ্টি কম এবং এগুলো বারবার খাওয়ার ফলে মায়ের ওজন ভাড়া ছাড়া আর কোন উপকার হয় না। গর্ভাবস্থায় কিছুটা ওজন বাড়ানোর প্রয়োজন হলেও অতিরিক্ত ওজন বাড়লে শিশুর প্রসবে জটিলতা হতে পারে এবং শিশু স্থূলতা ও ডাইবেটিস এ ভুগতে পারে।
কাঁচা বা আধা সেদ্ধ ডিম
আধা সেদ্ধ ডিম বা কাঁচা ডিম খেলে মায়ের শরীরে salmonella ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করতে পারে। এর ফলে জ্বর, বমি, পায়খানা, পেট ব্যথা হয়। যা থেকে ভ্রুণের ক্ষতি, সময়ের আগে সন্তান প্রসব এমনকি মৃত সন্তানের প্রসবেরও আশঙ্কা থাকে।
এ কারণে কাচা ডিম বা আধা সেদ্ধ ডিমের পাশাপাশি কাঁচা ডিম যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। তবে ডিম সেদ্ধ বা পুরোপুরি বেজে খেলে, কোন ভয় নেই।
অত্যধিক ক্যাফিন
আপনার যদি ক্যাফিন জাতীয় খাবার যেমন চা-কফি, সফট ড্রিংস এবং এনার্জি ড্রিঙ্কস খাবার অভ্যাস থাকে, তাহলে গর্ভাবস্থায় তা খেতে পারলেও তা ২০০ মিলিগ্রামের বেশি নয়। এক্ষেত্রে ইনস্ট্যান্ট কফি দিনে দুইবারের বেশি খাওয়া উচিত হবে না।
ফিল্টার কফি বা চা দিনে এক থেকে দুই কাপ পর্যন্ত খেতে পারেন। অতিরিক্ত ক্যাফিন খাবার ফলে, ভ্রুণের বৃদ্ধি আটকে যেতে পারে, অর্থাৎ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মাতে পারে। এমনকি মায়ের গর্ভপাত এবং মৃত সন্তানও প্রসব হতে পারে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সফট ড্রিঙ্কসে ক্যাফিন অল্প পরিমাণে থাকলেও কুইউইন নামের এক ধরনের রাসায়নিক উপাদান থাকে। এছাড়া ডায়েট সোডা বা খাবার সোডা সেকলিন থাকে, যা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
তাই সফট ড্রিংকস এবং এনার্জি ড্রিংকস পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। তবে গর্ভাবস্থায় মায়ের যদি খুবই ইচ্ছে হয়, দিনে ৪,৫ টুকরো ডাক চকলেট বা মিল্ক চকলেট খেতে পারেন।
মদ ও ধূমপান
গর্ভাবস্থায় মা যদি মদ পান করেন, তবে তার মৃত সন্তান জন্ম দেওয়ার আশঙ্কা সংখ্যা বেড়ে যায়। এমনকি ভ্রুণের বিকাশ ঠিকমতো হয় না। ইউনিসেফ এর তথ্যমতে, গর্ভে থাকাকালীন অ্যালকোহলে সংস্পর্শে আসা শিশুদের প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মানো এবং তাদের স্নায়ুজনিত রোগ পাওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে।
এছাড়া ভ্রুণের ফেটেল এলকোহল সিনড্রোম হতে পারে। এতে শিশুর জন্মের পর হার্টের সমস্যা সহ অন্যান্য অঙ্গে নানা জটিলতা এমনকি শিশুর বুদ্ধি বিকাশে সমস্যা দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে শিশুকে সুস্থ ভাবে জন্ম দিতে বাবা-মা দুজনকেই ধূমপান থেকে দূরে থাকতেই হবে।
ধূমপান সেটা মা করুক কিংবা আশেপাশের কেউ, এটি গর্ভে থাকা শিশুর অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দেয়। যার কারণে শিশুর হাঁপানি, বা অন্যান্য গুরুতর অসুস্থতার ঝুঁকি বাড়ে। এর পাশে শিশু কম ওজন নিয়েও ভূমিষ্ঠ হতে পারে।
ভেষজ চা ও মধু
গর্ভা কালীন সময়ে মা ও শিশুর উপর হারবাল বা ভেষজ পণ্যের প্রভাব কেমন? সে বিষয়ে বিস্তর কোন গবেষণা নেই। বিভিন্ন ভেষজ উপাদান না ও শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তবে ব্রিটেনের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ বলছে, মা চাইলে এক থেকে দুই কাপ হার্বাল চা খেতে পারেন।
এতে তেমন কোন সমস্যা হবে না। যাদের আবার জষ্ঠী মধু খাবার অভ্যাস আছে, তারা গর্ভা অবস্থায় তা খেতে পারেন। শুধু শিকর খাওয়া এড়িয়ে যেতে হবে।
ফল ও সবজি
ফল ও সবজি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ, পরিবহন বা বিক্রির সময় toxoplasma, E coli, listeria নামে নানা পরজীবী ও ব্যাকটেরিয়া ধারা আক্রান্ত হতে পারে এবং এর প্রভাবে মায়ের গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে।
অন্যদিকে শিশু দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে, এবং বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই যে কোন সবজি বা ফল খাওয়ার আগে, তা ভালোভাবে ধুয়ে, খোসা ছাড়িয়ে টাটকা অবস্থায় খাওয়া প্রয়োজন। ফল বা সবজিতে খোসা থাকলে, ওপরের আবরণের সাথে ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবী চলে যায়।
তবে যেসব ফল ও সবজিতে খোসা নেই, এগুলো ধোয়ার পর রান্না করে খাওয়াই নিরাপদ। খোসাহিন ফল ও সবজির জুস খাওয়া ও নিরাপদ হতে পারে।
অঙ্কুরিত খাবার
আলফাফা, মুলা, ডাল, ছোলা অঙ্করিত অবস্থায় কাঁচা খাওয়া, বেশ স্বার্থপর হলেও গর্ভবতী নারীদের জন্য ভালো নয়। কেননা বিজের অঙ্কুরোদগম হওয়ার জন্য যে আদ্র পরিবেশ প্রয়োজন, তাতে salmonella ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে।
এবং এই ব্যাকটেরিয়া পানিতে ধুয়ে যায় না। তাই এগুলো কাঁচা অবস্থায় খেলে, মায়ের পেটে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এবং শিশুর বৃদ্ধি আটকে যেতে পারে। তবে এসব অঙ্কুরিত খাবার সম্পূর্ণ রান্না করে খেলে, তা শতভাগ নিরাপদ।
অন্যান্য
পানি স্বল্পতা এড়াতে গর্ভবতী নারীদের প্রচুর পানি খেতে হবে। তবে এই পানি দূষিত হলে বিপদ হতে পারে। তবে আপনি যে এলাকায় আছেন, সে এলাকার পানি কতটা নিরাপত্তা যাচাই করে নিন। আবার আপনার যদি চিনা বাদাম বা অন্যান্য খাবারে এলার্জি থাকে, তাহলে গর্ভাবস্থায় তা অবশ্যই এড়িয়ে যাবেন।
এলার্জি না থাকলে কোন খাবার খেতেই বাধা নেই। এছাড়া গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকরা মায়েদের বিভিন্ন ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন ধরনের ওষুধ, বিশেষ করে ভিটামিন A সাপ্লিমেন্ট খাবেন না।
এর বাইরে মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার, রাস্তার খোলা খাবার, বাসি খাবার, প্রিজারজেটিভ দেওয়া প্যাকেটজাত খাবার, অতিরিক্ত চিনি লবণ, তেল ও মসলাদার খাবার, এড়িয়ে যেতে হবে।
No Comment! Be the first one.