গ্রীষ্মকালে আসে বিভিন্ন রকমের আনন্দের মুহূর্ত। কারণ গ্রীষ্মকালে আমরা সুন্দর একটি উষ্ণ আবহাওয়া পেয়ে থাকি। শুধু তাই নয় এটি বাইরে বের হওয়ার একটি উপযুক্ত সময়ও বটে। অর্থাৎ আমরা চাইলে পরিবারের সঙ্গে মধুর সময় কাটাতে পারি।
কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, গরমকাল আমাদের স্বাস্থ্যের ওপরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে অতিরিক্ত গরম ও আদ্রতার মধ্যে যদি শরীরের স্বাভাবিক তাপ নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলে আমরা অসুস্থ হয়ে যেতে পারি।
আজকের এই আর্টিকেলটিতে আমি আলোচনা করব, গরমের সময়ে শরীর সুস্থ রাখার কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস নিয়ে।
অতিরিক্ত গরমে যেসব সমস্যা দেখা দিতে পারে
গরমের সময়ে আমাদের শরীর কিছু সাধারণ অসুস্থতায় ভুগতে পারে। এর মধ্যে হিট স্ট্রোক অন্যতম, তারপর শরীরে পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে, পাশাপাশি শরীরে লবণের ঘাটতি দেখা দিতে পারে, তাছাড়া গরমের ফলে ঘাম জমে ত্বকে র্যাশ তৈরি হওয়া। নিচে এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
হিটস্ট্রোক
গরমে সবচেয়ে বেশি যে অসুস্থতাটি হয় সেটি হতে হিট স্ট্রোক। এ সময় শরীরে তাপমাত্রা অত্যাধিক বেড়ে যায়। হিট স্ট্রোক হয় তখনই যখন শরীর স্বাভাবিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
যেসব লক্ষণগুলোর কারণে হিট স্ট্রোক হয়ে থাকে সেগুলো হচ্ছে – তীব্র মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, শরীরের তাপমাত্রায় ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হওয়া, হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব হওয়া এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
এ সময় দ্রুত চিকিৎসা না নিলে মারাত্মক ক্ষতির ঝুঁকি থেকে যায়। স্ট্রোক থেকে বাঁচতে হলে আপনাদেরকে অবশ্যই প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে, ছায়ায় থাকতে হবে এবং সূর্যের তাপ থেকে দূরে থাকতে হবে।
শরীরে পানি শূন্যতা
গরমকালে একটি সাধারণ কিন্তু গুরুতর সমস্যা হচ্ছে শরীরে পানি শূন্যতা বা ড্রিহাইড্রেশন। গরমকালে অতিরিক্ত ঘামার ফলে আমাদের শরীর থেকে প্রচুর পানি এবং প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ বের হয়ে যায়, যা ডিহাইড্রেশনের কারণ হতে পারে।
এর ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, মাথা ব্যাথা হয় এবং ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। এছাড়াও তৃষ্ণা পাওয়া, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং মাথা ঘোরা ইত্যাদি হচ্ছে ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে অবশ্যই আমাদের পানি ও ইলেকট্রোলাইট সমৃদ্ধ পানিও পান করতে হবে।
অর্থাৎ গরমের সময় নিয়মিত তরল গ্রহণ করে শরীরকে পানি শূন্যতার ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে হবে।
হিট ক্র্যাম্পস
গরমে দীর্ঘ সময় বাইরে থাকার কারণে পেশীতে ব্যথা ও সংকোচন হতে পারে। বিশেষ করে গরমের প্রচুর ঘামার ফলে শরীর থেকে লবণ ও খনিজ পদার্থ বের হওয়ার ফলে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। হিট ক্র্যাম্পস হলে সাধারণত হাত, পা এবং পেশী গুলিতে ব্যথা এবং টান অনুভূতির মাধ্যমে এটি প্রকাশ পায়। যারা গরমে শারীরিক পরিশ্রম করে অথবা খেলাধুলা করেন, তাদের এই সমস্যাটি বেশি দেখা দেয়। এটি থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই আমাদের পর্যাপ্ত পানি ও ইলেক্ট্রো লাইট সমৃদ্ধ পানীয় গ্রহণ করতে হবে। এবং অতিরিক্ত গরমে দীর্ঘ সময় শারীরিক পরিশ্রম করা থেকে বিরক্ত থাকতে হবে। যার ফলে আমাদের শরীরের লবণ এবং পানির ভারসাম্য বজায় থাকবে।
হিট র্যাশ
হিট র্যাশ হলে সাধারণত গরম এবং আদ্র আবহাওয়ায় ঘাম জমে ত্বকে ছোট ছোট ফুসকুড়ি হতে পারে। সাধারণত হিট র্যাশ শরীরের এমন জায়গায় হয় যেখানে ঘাম বেশি হয়। যেমন: ঘাড়, বুক, কাঁধ বা বগলের নিচে।
আমাদের ত্বকের রোমকূপ যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন ঘাম বের হতে পারেনা। যার ফলে লালচে ফুসকুড়ি তৈরি হয়, যা প্রচন্ড চুলকানি এবং অস্বস্তির কারণ ও বটে। শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা দেয়। পাশাপাশি বয়ষ্করাও এতে আক্রান্ত হতে পারে।
এটি প্রতিরোধ করতে অবশ্যই শরীরকে ঠান্ডা রাখতে হবে, ঢিলে ঢালা ও আরামদায়ক পোশাক পরা এবং ত্বক পরিষ্কার রাখতে হবে।
অতিরিক্ত গরমে অসুস্থতা প্রতিরোধের উপায়
পানি পান করা
গরমে যেহেতু ডিহাইড্রেশনের ঝুঁকি থাকে। কারণ অতিরিক্ত ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে প্রচুর পানি ও খনিজ পদার্থ বের হয়ে যায়। অবশ্যই শরীরকে সুস্থ রাখতে নিয়মিত পানি পান করতে হবে। শরীরের পানি চাহিদা পূরণ করতে, অবশ্যই দিনে অন্তত 8 থেকে 10 গ্লাস পানি পান করা উচিত।
এর পাশাপাশি আপনি চাইলে পানি ছাড়াও রস, শরবত, কিংবা ইলেকট্রোলাইটসমৃদ্ধ পানিও গ্রহণ করতে পারেন। কারণ এগুলোর মাধ্যমে ও শরীরের প্রয়োজনীয় লবন ও খনিজ পদার্থের ঘাটতি পূরণ হবে। অর্থাৎ পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করলে, গরমের সময় আমাদের শরীরকে ঠান্ডা রাখার পাশাপাশি ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করাও সম্ভব।
বাহিরে কাজ কমানো
গরমের দিনে দুপুরের সময় সূর্যের রোদ সবচেয়ে বেশি তেজস্ক্রিয় থাকে। কারণ এ সময় শরীরে তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়। অর্থাৎ এ সময় বাইরে কাজ করলে হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন, বা হিট ক্র্যাম্পসের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
তাই দুপুরে বাইরে কাজ করা এড়িয়ে চলা উচিত। যদি জরুরী কারণে বাইরে যেতেই হয়, তাহলে ছাতা ব্যবহার করা বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকা ভালো। এর পাশাপাশি আপনি চাইলে হালকা ঢিলেঢালা পোশাক পরা এবং নিয়মিত বিরতিতে পানি পান করতে পারেন। যাতে শরীর ঠান্ডা থাকবে এবং অতিরিক্ত তাপ থেকে সুরক্ষা ও পাওয়া যাবে।
হালকা খাবার খাওয়া
গরম সময়ে তেল ও মসলাদার খাবার হজমের সমস্যা তৈরি করতে পারে। কারণ তেল ও মসলাদার খাবার শরীরে তাপমাত্রা বাড়ায় এবং হজম প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়। ফলে অস্বস্তি ও পেটের গ্যাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এজন্য অবশ্যই হালকা তাজা এবং পানিযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত। যেমন: ফল-সবজি, সালাদ ও দই।
এই খাবারগুলো আমাদের শরীরকে ঠান্ডা রাখতে এবং হজম প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক রাতে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি আপনি চাইলে পানি যুক্ত খাবার যেমন : তরমুজ, শসা ইত্যাদি খেলে আমাদের শরীরের পানি শূন্যতা কমে এবং শরীর সতেজ থাকে। এই নিয়মগুলো মেনে চললে গরমের সময় সুস্থ থাকা সম্ভব।
সঠিকভাবে বিশ্রাম নেয়া
গরমের সময় শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া অবশ্যই জরুরি। অতিরিক্ত গরমের ফলে আমাদের শরীর সহজে ক্লান্ত হয়ে যায়, যা শারীরিক ও মানসিক অস্বস্তি বাড়াতে পারে। নিয়মিত ও সঠিকভাবে ঘুমানো শরীরকে সতেজ রাখে এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে।
রাতে সময় মত ঘুমাতে যাবার পাশাপাশি দিনের ব্যস্ততার মধ্যে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে শরীরে কর্মক্ষমতা ও সতেজতা বজায় থাকে। তাছাড়া গরমে পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অসুস্থ হওয়া ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই এ থেকে বাঁচতে হলে নিয়মিত বিশ্রাম নিতে হবে।
গরমে শিশু ও বয়স্কদের জন্য বিশেষ যত্ন
গরমের সময় শিশু ও বয়স্কদের প্রতি অতিরিক্ত যত্ন নেওয়া বিশেষ জরুরি। কারণ এই সময়ে তাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কম থাকে। শিশুদের ত্বক অনেক বেশি সংবেদনশীল থাকে। তাই তাদেরকে সরাসরি রোদে নিয়ে যাবেন না এবং হালকা, ঢিলেঢালা কাপড় পরাবেন।
গরমের সময় শিশু ও বয়স্কদের প্রচুর পানি এবং তরল খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন, যাতে তারা ড্রিহাইড্রেশন থেকে রক্ষা পেতে পারে। তাছাড়া গরমের সময় বাইরে যাওয়ার সময় ছায়াময় স্থানে থাকার চেষ্টা করতে হবে। এবং চেষ্টা করবেন অল্প সময়ের জন্য বাইরে থাকার, এতে তারা সুস্থ থাকবে।
গরমে বাড়ির ভেতর কিভাবে সুস্থ থাকবেন?
গরমের সময় বাড়ির ভেতর সুস্থ থাকার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। ঘরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়োজন হলে ফ্যান বা এয়ারকন্ডিশনার ব্যবহার করতে পারেন। জানালা দিয়ে তাজা বাতাস প্রবাহিত করার চেষ্টা করবেন, তবে রোদ ঢাকার জন্য পর্দা টানা রাখা ভালো।
এর পাশাপাশি হালকা, পোশাক পরা এবং প্রচুর পানি পান করতে হবে। তাজা ফল ও সবজি খাবেন। মাঝেমধ্যে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে গোসল করুন বা ভিজা কাপড় দিয়ে ত্বক মুছে নিন। পরিশেষে বলা যায়, নিয়মিত বিশ্রাম এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করলে গরমের সময় সুস্থ থাকা যাবে।
No Comment! Be the first one.