মানুষ স্বভাবগতভাবে দুর্বল হয়ে থাকে কিছু কিছু বিষয় পছন্দের বেলায়ও সকলে একমত, কিছু জিনিস সকলে পছন্দ করে, দেখলে খুশি হয়, আবার এমনও কিছু জিনিস আছে, যা কেউ পছন্দ করে না। বিপরীতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে রুচি-ভিন্নতা দেখা যায়। বিষয়টি কেউ কেউ পছন্দ করলেও অন্য কারো কারো বিষয়টাই পছন্দ হয় না। মিষ্টি-হাস্যোজ্জ্বল চেহারা সকলে পছন্দ করে, মলিন-ভ্রুকুঞ্চিত মুখাবয়ব কেউ পছন্দ করে না।
ঠাট্টা-রসিকতা? কেউ খুব পছন্দ করলেও অনেকের কাছে সেটাই বিরক্তির কারণ। অনেকে এমন আছেন, যারা সকলেকে নিয়ে চলতে ভালোবাসেন, আবার অনেকে সম্পূর্ণ একা থাকতেই পছন্দ করেন। কেউ চায় সারাদিন কথাবর্তা, গল্পগুজবে মুখরতা, আবার কেউ ভালোবাসে নীরবতা-নির্জনতা। এ আচরণ ভিন্নতা থাকার কারণে প্রত্যেকেই সাধারণত এমন ব্যক্তির সাথে চলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে, যার আচরণ তার স্বভাবের অনুকূল।
প্রশ্ন উঠতে পারে, মানুষের পারস্পরিক মেলামেশার সময় সকলের স্বভাব অনুকূল হয় না কেন? প্রত্যেকের আচরণ অপরের রুচি বুঝে হয় না কেন? একবার একজন লোক একটি বাজপাখিকে একটি কাকের পাশে উড়তে দেখলো। পাখির রাজা বাজকে সামান্য একটা কাকের পাশে উড়তে দেখে লোকটি বেশ আশ্চর্য হলো। সে মনে মনে ভাবলো, এদের মাঝে কোনো বিষয়ে মিল আছে বলেই এরা একত্র হতে পেরেছে। সে পাখি দুটির প্রতি লক্ষ রাখতে শুরু করেন।
একসময় পাখি দুটি ক্লান্ত হয়ে মাটিতে নেমে এলো। লোকটি কাছে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখলো, উভয় পাখিরই এক পা ভাঙ্গা! আমাদের যেটি লক্ষ রাখতে হবে, তাহলো প্রত্যেকের সাথে তার রুচি ও মেজাজের অনুকূল আচরণ করা। কারো পিতা নীরবতা ভালোবাসেন, অধিক কথাবার্তা তার পছন্দ নয়। তাহলে ছেলের উচিত বাবার সাথে কথা বলার সময় বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখা। তাহলে বাবা সন্তুষ্ট হবেন। আপনাকে আরো বুঝতে হবে, স্ত্রী যদি বুঝতে পারে, তার স্বামী রসিকতা পছন্দ করে তাহলে সে তার নিকট রসিকতা করতে পারে, অন্যথায় তা থেকে বিরত থাকবে।
সহকর্মী, প্রতিবেশী, ভাই-বোন সবার ক্ষেত্রেই স্বভাব বুঝে ব্যবহার করার এই আচরণদক্ষতার প্রয়োগ জরুরী। মনে রাখতে হবে, সব মানুষের স্বভাব ও রুচি, পছন্দ ও চাহিদা এক নয়। মানুষের স্বভাব-ভিন্নতা যেন রঙ ও বর্ণের চেয়েও বৈচিত্রময়।
আমার মনে পড়ে এক বৃদ্ধা ভদ্র মহিলার কথা। তিনি আমার এক বন্ধুর মা। আমার মন্নেধ্যে একজনের তিনি খুব প্রশংসা করতেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার নিকট আলোচনা করতে পছন্দ করতেন। অন্য ছেলেরাও মায়ের সাথে সদাচরণ করতো। তবু কেন যেন বৃদ্ধার মন তার ঐ ছেলেটির দিকেই ঝুঁকে ছিল। আমি রহস্যটা উদঘাটন করতে চাইলাম। সুযোগ বুঝে একবার তার কাছে বিষয়টি জিজ্ঞেস করে বললাম। এরপর সে আমাকে বলল, আসলে সমস্যা হলো আমার ভাইয়েরা আম্মার রুচি ও মেজাজ বোঝে না।
এজন্য তাদের উপস্থিতি আম্মার জন্য বিরক্তিকর ও ভারী মনে হয়। আমি একটু রসিকতা করে বললাম, আচ্ছা। তাহলে জনাবই শুধুমাত্র মায়ের রুচি ও মেজাজ অনুধাবন করতে পেরেছেন। সে হেসে হেসে বলল, হ্যাঁ অবশ্যই। আমি রহস্যটা তোমাকে বলছি। মূলত আমার আম্মাও অন্যান্য বৃদ্ধাদের ন্যয় মেয়েলি বিষয়ে কথা বলতে ও শুনতে পছন্দ করেন। যেমন ধরুন, কার কবে কোথায় বিয়ে হলো? কার তালাক হলো? অমুকের কয় সন্তান? তাদের মধ্যে বড় কে? ওমুক ছেলে তমুক মেয়েকে করে বিয়ে করেছে? তাদের প্রথম সন্তানের নাম কী?
এ জাতীয় আরো অনেক কথা যেগুলো আমরা অপ্রয়োজনীয় মনে করলেও আম্মা বারবার বলে ও শুনে আনন্দ পান। তার কাছে এসব বিষয় ও তথ্য মহামূল্যবান। কারণ এগুলো আমরা বই, অডিও টেপ, ইন্টারনেট-কোথাও পাবো না! আমিও আম্মার কাছে গেলে এসব প্রসঙ্গ তুলতে পারি। আম্মা খুশি হয়ে আমার সাথে জমিয়ে গল্প করেন। তিনি ভাবেন, এসব তথ্য তিনিই প্রথম আমারে সরবরাহ করেন। গল্প করতে করতে তার মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। আমিও তার কাছে বসলেই এ সব প্রসঙ্গ তুলে দিই।
তিনিও দীর্ঘ সময় জুড়ে এ সব আলোচনা করতে থাকেন। বিশেষ করে ভাইয়েরা এসব মেয়েলি আলোচনা শুনে অভ্যস্ত নয়। তারা আমার সাথে অন্য সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে যায়। তখন আম্মার তা ভালো লাগে না। এজন্য আম্মা আমাকে পেলেই খুশী হন। এই হলো আমার কৃতিত্ব। আপনিও যদি কারো পছন্দ ও অপছন্দের বিষয়গুলো জানতে পারেন ও তার স্বভাব ও রুচিবোধ বুঝতে পারেন, আপনার জন্য তার মন জয় করা কোনে ব্যাপারই নয়।
মানুষের সাথে রাসূল (সা.) আচরণনীতি নিয়ে কেউ চিন্তা করলে সহজেই বুঝতে পারবে, রাসূল (সা.) প্রত্যেকের অভিরুচি বিচার করে তার নিকট আচরণ করতেন। এমনকি স্ত্রীগণের সাথে আচরণের ক্ষেত্রেও তিনি লঙ্ রাখতেন কার সাথে কীরূপ ব্যবহার করা উপযোগী হবে। আম্মাজান আয়েশা (রা.) একটু উচ্ছল স্বভাবের ছিলেন বিধায় রাসূল (সা.) তার নিকট রসিকতা করতেন। এক সফরে আয়েশা (রা.) রাসূল (সা.)-এর সাথে ছিলেন। ফেরার পথে কাফেলা যখন মদিনার কাছাকাছি পৌঁছলো, রাসূল (সা.) অন্যান্য সফর সাথীদের বলেন, তোমরা সামনে এগিয়ে যাও।
এমনিভাবে রাসূল (সা.)-এর আদেশে সকলে সামনে এগিয়ে যায়। রাসূল (সা.)-এর পাশে শুধু আয়েশা (রা.) দাঁড়িয়ে আছেন। অল্প বয়সী হওয়ায় তার মধ্যে তারুণ্যের চঞ্চলতা ছিল। রাসূল (সা.) মৃদু স্বরে বলেন, হে আয়েশা চলো, তোমার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা হবে। আয়েশা (রা.) রাসূল (সা.)-এর সাথে দৌড় শুরু করে একপর্যায়ে রাসূলকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন। বেশ কিছুকাল পর, আবার এক সফরে তিনি রাসূল (সা.)-এর সাথী হলেন।
তখন আয়েশা (রা.)-এর বয়সও কিছু বেড়েছে, শরীরও কিছুটা ভারী হয়েছে। রাসূল (সা.) অন্যান্য সফরসাথীদের বলেন, তোমরা সামনে এগিয়ে যাও। সকলে সামনে এগিয়ে যায়, রাসূল (সা.) আয়েশাকে বলেন, এসো আজ আবার তোমার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করবো। সেদিনের মত আজও আয়েশা দৌড় শুরু করেন। আজ রাসূল (সা.) আয়েশাকে পেছনে ফেলে আগে চলে গেলেন ও রসিকতা করে তার কধের মাঝে টোকা দিয়ে বলেন, আয়েশা! সেদিনের প্রতিশোধ নিলাম আজকের জয়ের মাধ্যমে! আজকের জয় সেদিনের প্রতিশোধ!
খাদিজা (রা.)-এর সাথে রাসূল (সা.)-এর আচরণ ছিল ভিন্ন। কারণ বয়সে তিনি রাসূল (সা.)-এর চেয়ে পনেরো বছরের বড় ছিলেন। সাহাবাদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রেও তিনি তাদের স্বভাবের প্রতি লক্ষ রাখতেন। তাই তিনি আবু হুরায়রা (রা.)-এর সাথে যে আচরণ করেননি যে আচরণ খালিদ (রা.)-এর সাথে করেন। আবার আবু বকর (রা.)-এর সাথে যেরূপ ব্যবহার করেন, তালহা (রা.)-এর সাথে তেমন করেননি। উমর (রা.)-এর সাথে রাসূল (সা.)-এর আচরণ ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র।
তাকে এমন অনেক কাজে সমর্থন করতেন, যা অন্য কারো ক্ষেত্রে করতেন না। এমন অনেক বিষয়ে তার ওপর নির্ভর করতেন, যা অন্য কারো ক্ষেত্রে করতেন না। বদর যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্তের একটি ঘটনা যা রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামের নিয়ে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। ইতোমধ্যে জানতে পারলেন, কুরাইশরাও এগিয়ে আসছে।
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কুরাইশদের মধ্যে এমন কিছু লোকও আছে, যারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও রণাঙ্গনে উপস্থিত হবে, অথচ মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছা তাদের নেই। নবীজী (সা.) সাহাবাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি জানতে পেরেছি, বনু হাশেম ও অন্যান্য গোত্রের কিছু কিছু লোক খুবই অনিচ্ছা সত্ত্বেও যুদ্ধের ময়দানে আসতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের সাথে তাদের যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা নেই। বনু হাশেমের কেউ তোমাদের সামনে পড়ে গেলে তাকে যেন হত্যা না করা হয়।
আবুল বুখতারী বিন হিশামকে কেউ যদি দেখে তাহলে তাকে যেন হত্যা না করে। আব্বাস বিন আব্দুর মোত্তালিবকেও কেউ যেন কতল না করে। কেননা সে একান্ত অনিচ্ছাতেই ময়দানে আসতে বাধ্য হয়েছে।
মূলত, আব্বাস (রা.) পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বন্ধে এদিকে তিনি যেন সুরাইশদের সাথে থেকে তাদের বিভিন্ন তৎপরতা সেথেচ্ছে রাসূল (সা.)-কে কুরাইশদের তো পারেন এ উদ্দেশ্যে বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। রাসূল তার ভূঅবগাত গ্রহণের বিষয়টিও গোপন রাখতে চাচ্ছিলেন, আবার কোনো মুসলমান যেন তাকে হত্যা না করে সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে চাচ্ছিলেন। যেন ভয় ছিল মুসলমান ও কুরাইশদের মাঝে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ। মুসলমানরা ছিল অপ্রস্তুত।
পরিস্থিতির শিকার হয়ে তারা এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো। ফিলামের খাতিরে মুসলমানরা হাতিয়ার নিয়ে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে নিজের লিজাপুর কোনো আত্মীয়ের। এ ছিল ঈমানের এক অগ্নিপরীক্ষা। এই চরম মুহূর্তে রাসূল বিশেষ কিছু লোককে হত্যা করতে নিষেধ করেন। উল্লেখ্য, ওতবা বিন রাবিয়া ছিলেন কুরাইশদের অন্যতম নেতা বদরযুদ্ধে কাফির বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি। তার পুত্র আবু হোযায়ফা বিন ওতবা রাসূল (সা.). এর সাহাবি।
আবু হোযায়ফা (রা.) ধৈর্য হারিয়ে বলে ফেললেন, আমরা আমাদের পিতা, পুত্র ও ভাইদেরকে হত্যা করব আব্বাসাকে ছেড়ে দেবো। খোদার কসম। আমি যদি তার দেখা পাই, আমার তরবারি তার ভাগ্যের ফায়সালা করবে। তার এ কথাগুলো যখন রাসূল (সা.)-এর কানে পৌঁছে। তখন রাসূল (সা.) ফিরে তাকালেন। তার চারপাশে তিনশত বীরযোদ্ধা। এভাবেই তার দৃষ্টি বিশেষভাবে ওমরের ওপর পড়লো ও তিনি আর কেরো দিকে না তাকিয়ে উমর বলেন, আবু হাফস! ওাসূল (সা.)-এর চাচার চেহারায় তরবারি দ্বারা আঘাত কর হবে? ওমর (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ করে বলছি! সেদিনই প্রথম রাসূল (সা.) আমাকে আবু হাফস উপনামে সম্বোধন করেন।
এমন পরিস্থিতিতে উমর রাসূল (সা.)-এর ইশারা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি জানতেন, যুদ্ধের ময়দানে সেনাপতির সিদ্ধান্তের বিরোধিতাকারীর সাথে আচরণের ক্ষেত্রে সামান্য ভুলও আত্মঘাতী বিপদ ডেকে আনতে পারে। সাথে সাথে উমর একটি দৃঢ় সমাধানের পথ বেছে নিলেন। তিনি হুঙ্কার ছেড়ে বলেন, হে রাসূল! আপনি অনুমতি দিন, আমি তরবারি দিয়ে ওর গর্দান উড়িয়ে দিই। রাসূল (সা.) তাকে শান্ত করেন। তিনি জানতেন, ওমরের এ হঙ্কার পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য যথেষ্ট।
আবু হুযায়ফা (রা.) সৎ মনের মানুষ ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বলতেন, সেদিন আমি যে কথা বলেছিলাম তার কারণে আজও নিজেকে নিরাপদ মনে করি না আমি ততদিন ভীত-সন্ত্রস্ত্রই থাকবো যতদিন না শাহাদাত লাভের মাধ্যমে আমার এ অপরাধের বদলা হয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি ইয়ামামার যুদ্ধে শাহাদাত বরুণ করেন।
উমর (রা.) রাসূল (সা.) ভলোভাবেই জানতেন, কোনো ধরণের কাজের দায়িত্ব ওমরের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। বিষয়টি ট্যাক্স উসুল করা, বিদ্যমান দুদলের মাকে মীমাংসা করা কিংবা কোনো অজ ব্যক্তিকে শিক্ষা প্রদান করার পর্যায়ের ছিল না। এটি ছিল তত্ত রণাঙ্গনের একটি সিদ্ধান্তের বিষয়। এক্ষেত্রে এমন বাক্তির দরকার ছিল, যে অন্যদের থেকে বেশি প্রভাব ও দৃঢ়তার অধিকারী। এজন্য রাসূল ওমরকেই এ কাজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন আর তার চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে বলেন, আবু হাফস।
রাসূল (সা.)-এর চাচার চেহারায় তরবারি যারা আঘাত করা হবে? আমরা রাসূল (সা.)-এর দিকে তাকিয়ে দেখি রাসূল (সা.) গাযওয়ায়ে খায়বারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। সামান্য প্রতিরোধের পর খায়বারের ইহুদীরা রাসূল (সা.)-এর সাথে সন্ধি করল ও রাসূল (সা.) খায়বারে প্রবেশ করেন। রাসূল শর্তারোপ করেন, কেউ কোনো সম্পদ, সোনা-রূপা, টাকা-পয়সা লুকাতে পারবে না। সব কিছু উপস্থিত করতে হবে ও তার ওপর শরয়ী বিধান কার্যকর করা হবে।
সাথে সাথে রাসূল এ হুঁশিয়ারী বাক্যও উচ্চারণ করেন, কেউ যদি কিছু লুকিয়ে রাখে তাহলে মুসলমানগণ তার নিরাপত্তার দায়ভার নেবে না এবং সে সন্ধিচুক্তির আওতাভুক্ত হবে না। – হুয়াইন বিন আখতার ছিল ইয়াহুদিদের অন্যতম লিডার। নির্বাসিত হয়ে মদিনা থেকে খায়বারে আসার সময় সে সাথে করে সেলাই করে চামড়ায় ভরে স্বর্ণ অলঙ্কারাদি নিয়ে এসেছিল। এসব মাল রেখেই হুয়াই মারা যায়। তখন ইহুদীরা সেগুলো লুকিয়ে রাখলো।
হুয়াই এর চাচাকে রাসূল (সা.) বলেন, বনু নযীর থেকে হুয়াই যা নিয়ে এসেছিল, তা কোথায়? হুয়াই এর চাচা বলল, যুদ্ধ ও অন্যান্য খাতে খরচ হয়ে গেছে। একপর্যায়ে রাসূল (সা.) ভেবে দেখেন, হুয়াই যে সম্পদ এনেছিল, তা অনেক; অথচ সে মারা গেছে খুব বেশিদিন হয়নি। ইহুদীরা মদিনা থেকে আসার পর খায়বারে তেমন কোনো যুদ্ধবিগ্রহও হয়নি, যার জন্য এত বিপুল সম্পদ খরচ হবে। ন রাসূল (সা.) তাকে বলেন, এটা বেশি দিনের কথা নয় আর সম্পদ সে তুলনায় . প্রচুর।
হুয়াই এর চাচা জবাব দিলো, সম্পদ সব শেষ। কিছুই নেই। • রাসূল (সা.) বুঝে ফেললেন, লোকটি মিথ্যা বলছে। রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামের দিকে তাকালেন। বহু সংখ্যক সাহাবি সেখানে উপস্থিত। প্রত্যেকেই তার ইঙ্গিতে যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত। রাসূল (সা.) এ ক্ষেত্রে বেছে নিলেন যুবাইর বিন আওয়ামকে। তিনি বলেন, । যুবাইর। তার মুখ খুলতে একটু শাস্তির প্রয়োজন। যুবাইর (রা.) সাথে সাথে তার দিকে ভয়ংকর মূর্তিতে অগ্রসর হতে শুরু করেন। যুবাইরকে দেখে বেটা ইয়াহুদি না ভয়ে এতটুকুন হয়ে গেল।
সে বুঝতে পারলো, সত্য না বললে অতিসত্বর খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। বাঁচার জন্য সে তাড়াতাড়ি বলল, হুয়াইকে প্রায়ই দেখতাম, ঐ বাড়িটির পাশে ঘোরাফেরা করতো। সে একটি সমস্নো পরিত্যয় বাড়ির দিকে ইশারা করল। সাহাবায়ে কেরাম সেখানে গিয়ে চারপাশে বাড়ির দিকেল্লাশি চালালেন। অবশেষে বেরিয়ে এলো ব্যাকরতেন সম্পদ। রাসূল (সা.) যুবাইর (রা.)-কে এমন ক্ষেত্রেই ব্যবহারে। তারপর ধনক তার হাতেই দেয়া দরকার যে এর সঠিক ব্যবহার করতে পারে।
তারপর সাহাবায়ে কেরামও পারস্পরিক আচরণের ক্ষেত্রে এ নীতিই অবলম্বন করতেন। যখন রাসূল (সা.) তখন মৃত্যুপীড়ায় আক্রান্ত। রোগ-যন্ত্রণায় নামাজে ইমামতি করারও শক্তি নেই। শয্যাশায়ী অবস্থায় তিনি সাহাবায়ে কেরাম বলেন, তোমরা আবু বকরকে নামাযের ইমামতি করতে বলো। আবু বকর (রা.) একে ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের মানুষ, অধিকন্তু তিনি দুনিয়া-আখিরাতে রাসূল (সা.)-এর একনি সাথী, নবুওয়াতপূর্ব-পরবর্তী উচ্চ যুগের পরম বন্ধু, নবী-পত্নী আয়েশা (রা.)-এর পিতা।
এজন্য রাসূল (সা.) রোগ-যন্ত্রণা আবু বকর সিদ্দীকের অন্তরে পাহাড়সম বেদনা হয়ে চেপে বসেছিল। রাসূল (সা.) আবু বকর (রা.)-কে ইমামতি করার নির্দেশ পাঠালেন, তখন উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামের কেউ কেউ বলেন, আবু বকর কোমল স্বভাবের মানুষ। তিনি আপনার স্থানে দাঁড়ালে বিশেষ করে বর্তমান ক্ষেত্রে-আবেগ ও কান্নার কারণে নামায পড়াতে সক্ষম হবেন না।
রাসূল (সা.) এ আদেশের মাধ্যমে এ বিষয়ের প্রতি সুপ্ত ইশারা করতে চাচ্ছিলেন, তার ইন্তেকালের পদ খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার অধিক উপযুক্ত ব্যক্তি কে? রাসূল (সা.) এজন আবার আদেশ করেন, তোমরা আবু বকরকে নামাযের ইমামতি করতে বলো। অবশেষে আবু বকর (রা.) নামায পড়ালেন। স্বভাবগত কোমলতা থাকা সত্ত্বেঃ তিনি সঠিকভাবেই আপন দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষভাবে কোমল প্রকৃতির হলেও সেক্ষেত্রে আবু বকর (রা.)-এর প্রভাব ছিল অসাধারণ।
প্রয়োজনে গর্জে ওঠার গুণ তার কোমল স্বভাবে জালাল ও প্রতাপের চাঁদর জড়িয়ে দিয়েছিল। তার সারা জীবনের সহযাত্রী উমর (রা.) বিষয়ট জানতেন। এবার সেই দৃশ্যটির কথা কল্পনা করুন। রাসূল (সা.)-এ ইন্তেকালের পর খলীফা নির্ধারণের জন্য মুজাহির ও আনসার সাহাবীগণও বদ সাঈদার আঙিনায় সমবেত হয়েছেন। উমর (রা.) ও আবু বকর (রা.) সা সেখানে উপস্থিত হলেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষ বর্ণনা দিতে গিয়ে উমর (রা.) বলেন, আমরা বনু সাইদার অঙ্গনে একত্রে উপস্থিত হয়ে দেখলাম, এক আনসার সাহাবি বক্তব্য দিচ্ছেন। হামদ। সানা পাঠের পর তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যকারী দল। ইসলামের অগ্রসেনা। আমাদের মুহাজির ভাইয়েরা। আপনারা হলেন আমানে শাখাদল। আপনাদের কেউ কেউ আমাদের শেকড় উপড়ে ফেলতে চ্যা খেলাফত দায়িত্ব ছিনিয়ে নিতে চায়।
তার বক্তব্য শেষ হলে আমি কিছু বলতে মনস্থ করে মনে মনে এমন কিছু বক্তব্য সাজিয়ে নিলাম, যা আমার কাছে সম্পূর্ণ পরিবেশ-উপযোগী মনে হচ্ছিলো। প্রথমে আমি আবু বকর (রা.) কে বিষয়টি জানাতে চাইলাম। আমি তাকে কিছুটা ■ উত্তেজিত করতে চাইলাম। প্রত্যুত্তরে তিনি আমাকে বলেন, ওমর। শান্ত হও। আমি তাকে মনোক্ষুন্ন করতে চাইলাম না। তারপর তিনি বক্তব্য রাখলেন। নিঃসন্দেহে তিনি আমার চেয়ে জ্ঞানী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন।
আল্লাহর শপথ! আমি অনেক ভেবে-চিন্তে যে কথাগুলো বলার প্রস্তুতি নিলাম, তিনি কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই সে কথাগুলো বলেনই, তার চেয়েও উত্তম ও অধিক প্রভাব সৃষ্টিকারী অনেক কথা বলেন। আবু বকর (রা.) তার বক্তব্যে ব্যক্ত করে বলেন, হে আমার আনসারী ভাইগণ। আপনারা যেসব অবদানের কথা উল্লেখ করেন, নিঃসন্দেহে আপনারা তার যোগ্য। তবে আরবরা এ কথা ভালোভাবেই জানে, নেতৃত্বের সহজাত গুণ কুরাইশদের মাঝেই আছে।
আরব গোত্রসমূহের মধ্যে বংশধারা ও গোত্র বিবেচনায় কুরাইশরাই অধিক ন্যয়পরায়ণ। আমি তাদের মধ্য থেকে দু’জন ব্যক্তিকে পেশ করছি। আপনারা তাদের যে কারো হাতে বাইয়াত গ্রহণ করতে পারেন। তারপর তিনি আমার ও আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.)-এর হাত তুলে ধরলেন। আবু বকর (রা.)-এর বক্তব্যের এই অংশটি ছাড়া সমস্টাই আমার ভালো লেগেছিল। আবু বকর (রা.)-এর বর্তমানে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ অপেক্ষা বিনা অপরাধে শিরোচ্ছেদ হওয়াও যে আমার কাছে অধিক প্রিয়!
ঐ অবস্থায় সবার নীরবতার মাঝে এক আনসারী সাহাবি দাঁড়িয়ে বলেন, আমি সঠিক মানদন্ডের মাধ্যমে ইনসাফপূর্ণ একটি মত পেশ করছি। হে কুরাইশ সম্প্রদায়। আমাদের মধ্য হতে একজন নেতা নির্ধারিত হোক তোমাদের মধ্য হতে একজন নেতা নির্ধারিত হোক। তার এই মন্তব্যের পর চারদিকে এত বেশি কোলাহল ও চেঁচামেচি আরম্ভ হলো, আমি মুসলমানদের ঐক্যে ফাটল ধরার আশঙ্কা করলাম। আমি দ্রুত বললাম, আবু বকর। আপনি হাত বাড়িয়ে দিন।
তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন। সর্বপ্রথম আমি তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলাম। তারপর মুহাজিরগণ সকলে বাইয়াত হলো। তারপর আনসারগণ তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলেন। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সকল মানুষের হৃদয়-দরজা খোলার একটি চাবি আছে। সে চাবি ব্যবহার করে আপনি তার ভালোবাসা অর্জন করতে পারবেন, তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন। আমরা নিজেদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এ বিষয়টি লক্ষ করে থাকি। আপনি নিশ্চয়ই অনেক সময় আপনার সহকর্মীকে বলতে শুনেছেন, আরে। বসকে কাবু করার চাবি হলো অমুক। কোনো প্রয়োজন পড়লে তার মাধ্যমেই স্যারকে ম্যানেজ করবে। সেই বসকে রাজী করাতে পারবে।
আপনি কেন মানুষের হৃদয়-রাজ্য জয়ের এই চাবিটি ব্যবহার করেন না? সমাজে আপনি ভূমিকায় থাকার পরিবর্তে মাথা হয়ে থাকুন। দশজনের মত না হয়ে লেজের কমিন হোন। মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান প্রত্যেকের হৃদয়ের চাবি খুঁজে বের করুম। কর্মক্ষেত্রেও আপনার বস ও কলিগদের অন্তরে প্রবেশের পথটি বের করেন নিন। হৃদয় জয়ের চাবিটি হস্তগত করা গেলে একটি লাভ এও হবে, প্রয়োজনে তার মেজাজ বুঝে আমরা তাকে উপযুক্ত পন্থায় সদুপদেশ দিতে পারবো।
সেও নির্দ্বিধায় তা গ্রহণ করবে। কারণ নিজের ভুল অনুধাবন ও অন্যের পক্ষ থেকে ভুল সংশোধন ও সদুপদেশ তখনই কার্যকর হবে, যখন তা পাত্রের মেজাজ বুঝতে হবে। রাসূল (সা.)-এর সিরাতের প্রতি লক্ষ্য করে দেখুন। রাসূল (সা.) একবার সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে কথা বলছিলেন। হঠাৎ অপরিচিত এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করে। একটু পর সে মজলিসে বসার পরিবর্তে সোজা মসজিদের এক কোণায় চলে যায় এবং লুঙ্গি নাড়াচাড়া করতে শুরু করেন।
সকলে আঁতকে উঠলো। মসজিদের মধ্যে লোকটি কী করতে চাচ্ছে? সকলে অবাক হয়ে দেখলো, লুঙ্গির অগ্রভাগ উঁচু করে লোকটি নিশ্চিন্তে মসজিদের মধ্যে পেশাব করলো। তাকে মসজিদে পেশাব করতে দেখে সাহাবায়ে কেরাম ক্রোধে অস্থির হয়ে পড়লেন। কেউ কেউ তার দিকে তেড়ে যাচ্ছিলেন। তখন রাসূল (সা.) সকলেকে শান্ত করে তাদের উত্তেজনা প্রশমিত করেছেন। বারবার তিনি বলছিলেন, তাকে বাধা দিও না! তাকে তাড়াহুড়া করতে বাধ্য করো না!
তাকে শেষ করতে দাও! একপর্যায়ে সাহাবায়ে কেরামগণ লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, আগন্তুক লোকটি সাহাবায়ে কেরামের এসব প্রতিক্রিয়ার কিছুই লক্ষ করেনি। সে তার মত পেশাব করেই চলেছে। মসজিদের মধ্যে পেশাব করার মত অসহ্যকর দৃশ্য রাসূল (সা.) চুপ করে দেখেছেন, সাহাবীদের শান্ত করেন। আল্লাহু আকবার! ধৈর্যের কী কতো ধৈর্যশীল ছিলেন আমাদের প্রিয়নবি! চরম পরাকা। এরপর বেদুঈন লোকটি পেশাব শেষ করে যখন ধীরে-সুস্থে লুঙ্গি ঠিক করছিল, রাসূল (সা.) কোমল স্বরে তাকে কাছে ডাকলেন।
কাছে আসার পর দয়ার নবি খুব নরম স্বরে তাকে বলেন, মসজিদ এ জাতীয় কাজের জন্য তৈরি করা হয় না। মসজিদ শুধা নামায ও কুরআন তেলাওয়াতের জন্যে। আমি বলব, ব্যাস। একেবারে সংক্ষিপ্ত নসিহত। লোকটি রাসূল (সা.) উদ্দেশ বুঝতে পেরে চলে যায়। নামাযের সময় হলো লোকটি সবার সাথে জামাতে শরিক হলেন। এরপর রাসূল (সা.) নামায পড়ালেন। নামাযের মধ্যে রুকু থেকে ওঠার সময় রাসূল সামি আল্লাহু লিমান হামিদাহ পড়লেন।
মুকতাদীগণ সকলে বলল, রাব্বানা লাকাল হামদ, হে আমাদের প্রতিপালক! সকল প্রশংসা আপনার জন্যেই। এভাবে সেই বেদুঈন সাহাবীর সাথে আরো যোগ করল, হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতি ও মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি দয়া করুন এবং আপনার দয়ায় আমাদের সাথে আর কাউকে শরিক করবেন না। রাসূল (সা.)-এর কানে তার এ বাক্য পৌঁছলো। এরপর তিনি নামায শেষ করে সাহাবায়ে কেরামেদেরকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, কে কথা বলেছে? সকলে বেদুঈন সাহাবির দিকে ইশারা করল।
রাসূল (সা.) তাকে কাছে ডাকলেন। কাছে এলে রাসূল দেখেন, এ সেই ব্যক্তি যে মসজিদে পেশাব করেছিল। রাসূল (সা.) কোমল আচরণ তার হৃদয়ে নবি প্রেমের এমন সুদৃঢ় বন্ধন তৈরি করেছিল, সে দো’আ করছিল, আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া যেন শুধুমাত্র তারা দুজনই লাভ করেন, অন্য কেউ নয়। রাসূল (সা.) তাকে সঠিক পদ্ধতি শিক্ষা দেয়ার জন্য বলেন, তুমি একটি ব্যাপক বিষয়কে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছো। আল্লাহর রহমত সকলেকে পরিবেষ্টন করে আছে সেটাকে তুমি আমার ও তোমার মাঝে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছো।
রাসূল (সা.) কী সুন্দর পদ্ধতিতে লোকটির মন জয় করে নিলেন। কারণ তিনি জানতেন, একজন বেদুঈনের সাথে কীরূপ আচরণ করতে হবে। গ্রাম থেকে আসা এক সাদাসিধে বেদুঈনের জ্ঞান-স্তর কিছুতেই আবু বকর, উমর বা মুআয ও আম্মামের মত নয়। এজন্য তার নিকট রাসূল (সা.)-এর আচরণ পদ্ধতি অন্যদের তুলনায় ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। মুয়াবিয়া বিন হাকাম (রা.)-এর ঘটনা থেকেও আমরা চাইলে শিক্ষা নিতে পারি। তিনি ছিলেন সাধারণ সাহাবায়ে কেরামের একজন।
তিনি মদিনার অধিবাসী ছিলেন না বিধায় রাসূল (সা.)-এর সার্বক্ষণিক সাহচর্যও লাভ করেননি। তার কিছু বকরী ছিল। এজন্য সবুজ ঘাসের খোঁজে তিনি চষে বেড়াতেন বিস্তৃত মরুভূমি। একবার তিনি মদিনার মসজিদে উপস্থিত হয়ে দেখেন, রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামের সাথে হাঁচি দেয়ার বিদান সম্পর্কে আলোচনা করেন। রাসূল সাহাবায়ে কেরামদেরকে শেখালেন, কোনো মুসলমান অপর মুসলিম ভাইকে হাঁচি দিয়ে আলহামদু লিল্লাহ বলতে শুনলে উত্তরে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলবে।
তারপর মুয়াবিয়া (রা.) মাসয়ালাটি মুখস্থ করে নিলেন। তারপর চলে গেলেন নিজ কাজে। কিছুদিন পর তিনি কোনো প্রয়োজনে পুণরায় মদিনায় এলেন। মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে দেখেন, রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামের নিয়ে নামায পড়ছেন। তিনি নামাযে শরিক হলেন। তখন নামাযের মধ্যে মুসল্লীদের মধ্য হতে কেউ একজন হাঁচি দিলো। সাথে সাথে মুয়াবিয়ার মনে পড়লো, তিনি হে রাসূল (সা.)-এর কাছে শিখেছিলেন, মুসলমানের হাঁচির জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলতে হয়। হাঁচিদাতা এই বুঝি আলহামদু লিল্লাহ বলছে, এই ভেবে সাথে সাথে মুয়াবিয়া (রা.) উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন, ইয়ারহামুকাল্লাহ।
এরপর মুসল্লীগণ হকচকিয়ে গেল। এরপর অনেকে বিরক্তিভাব নিয়ে আফসোস তার দিকে তাকালো। সকলের অপ্রস্তুতভাব লক্ষ করে তিনি আন্তর হয়ে পড়লেন ৯২ ও তাদেরকে লক্ষ করে বলেন, আরে! তোমাদের কা হয়েছে? তোমরা আমত এভাবে তাকাচ্ছো কেন? দিয়েড়া মুসল্লিদের কেউ কেউ উরুর উপর হাতাইয়া চুপ করেনাকে চুপ থাকার ভায়াইশারা করল। ইশারা বুঝতে পেরে মুয়াবিয়া চুপ করেন। নামায শে জানুল (সা.) মুসল্লীদের দিকে ফিরলেন।
মুসল্লীদের অস্থিরতা ও একজনের কার আসুরার রাসূল (সা.) কানে পৌছেছিল। এই নতুন কণ্ঠের সাথে রাসূল (সা.) পর পরিচিত ছিলেন না। এজন্য তিনি বলেন, নামাযের মধ্যে কে কথা বলল? সকলে মুয়াবিয়া (রা.)-এর দিকে ইশারা করল। রাসূল (সা.) তাকে কাউ ডাকলেন। তিনি দুরু-দুরু বুকে এগিয়ে গেলেন। মনে ভয় হচ্ছে, না জানি অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। তিনি সবার নামাযে বিঘ্ন ঘটিয়েছেন, নামাদে একাগ্রতায় বাধা সৃষ্টি করেন।
মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, আমার পিতা-মাতা রাসূল (সা.)-এর শানে কুরবান হে আল্লাহর শপথ! আমি জীবনে এর পূর্বে বা পরে রাসূল (সা.)-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কোমল কোনো শিক্ষক দেখিনি। আল্লাহর শপথ! তিনি আমাকে না ভাস করেন, না তিরস্কার করেন আর না আমাকে প্রহার করেন। রাসূল (সা.) আরো বলেন, হে মুয়াবিয়া। নামাযের মধ্যে কথা বলার অনুমা নেই। নামায শুধুমাত্র তাসবীহ, তাকবীর ও কুরাআন তেলাওয়াতের নাম বাচ অতি কার্যকর নসীহত। এতটুকুই! সুসংক্ষিপ্ত অথচ স্বাভাবিকভাবে মুয়াবিয়া (রা.) মাসয়ালাটি বুঝতে পারলেন।
রাসূল (সা.)-এ এতটুকু কথায় তার হৃদয়জগত প্রশান্ত হয়ে যায়। এজন্য তিনি নিজের ব্যক্তিগু বিভিন্ন জিজ্ঞাসার কথা রাসূলকে বলতে শুরু করেন। তিনি বলেন, হে রাস্ত কিছুদিন পূর্বেও আমরা মূর্খতার অন্ধকারে ডুবে ছিলাম। মহান আল্লা আমাদেরকে ইসলামের দৌলত দান করেন। আমাদের মধ্যে অনের জ্যোতিষীর কাছে যায় যারা নিজেদের অদৃশ্যজ্ঞানী বলে দাবি করে। তা তাদের কাছে গায়ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। রাসূল (সা.) বলেন, তুমি তাদের কাছে যেয়ো না।
তুমি একজন মুসলমান আ মুসলমান মাত্রই এ কথা বিশ্বাস করে, গায়েবের জ্ঞান এক আল্লাহ ছাড়া অন কারো নেই। তাই কাদের কাছে যাওয়া তোমার জন্য সমীচিন নয়। তারগ মুয়াবিয়া বলেন, আমাদের মধ্যে অনেকে শুভ-অশুভ লক্ষণে বিশ্বাস করে। অর্থা উড়ন্ত পাখি দেখে শুভ-অশুভ নির্ণয় করে। উক্ত প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) বলেন, এ জাতীয় নির্ণয় শুধুমাত্র অন্তরেরই ধারণ বাস্তবে এর কোনো প্রভাব কিংবা বাধাদান-ক্ষমতা নেই অর্থাৎ এগুলো তানে দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। লাভ-ক্ষতির ক্ষেত্রে এগুলো কোনো ভূমিকা নেই।
এক বেদুঈন মসজিদে পেশার করা ও নামাজে কথা বলা এক ব্যক্তির সাথে এই হলো রাসূল (সা.) আচরণ। ব্যক্তি বিচারে তাদের ক্ষেত্রে এ আচরণই ছিল সঠিক ৩ পূর্ণ উপযোগী। কারণ এ জাতীয় মানুষের ভুল হওয়া একান্তই স্বাভাবিক। মুয়ায বিন জাবাল (রা.) নববী সোহবত ও ইলম অন্বেষণ-উভয় ক্ষেত্রে যিনি ছিলেন উঁচু মার্গের সাহাবায়ে কেরামের একজন, তিনি কোনো ভুল করলে রাসূল (সা.)-এর আচরণ ও সংশোধন পদ্ধতি অন্যদের তুলনায় ভিন্ন হতো।
সবসময় মু’য়ায (রা.) রাসূল (সা.)-এর পেছনে এশার নামায পড়তেন। দ্বিতীয়বারের এ নামায মুআয (রা.)-এর জন্য নফল ও অন্যদের জন্য ফরয হিসেবে গণ্য হতো। এক রাতের একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা তাহলো মু’আয (রা.) এলাকায় এসে তাকবীর দিয়ে এশার নামাযের ইমামতি শুরু করেন। ইতোমধ্যে সগোত্রীয় এক যুবক এসে নামাযে শরিক হলো। মুয়াজ সূরা ফাতিহা শেষ করেন। সকলে আমীন বলল। তারপর মু’আয সূরা বাকার আরম্ভ করেন। সে সময় লোকেরা সারা দিন ক্ষেত-খামারে কাজ করতো, পশু চরাতো; তারপর কোনো রকমে এশার নামায পড়েই শুয়ে পড়তো।
তখন যুবকটি নামাযে দাঁড়িয়ে আছে, মু’য়ায কেরাত লম্বা করেই যাচ্ছেন। একপর্যায়ে অস্থির হয়ে যুবকটি জামাত ছেড়ে দিয়ে একা নামায আদায় করে বাড়ি চলে যায়। অনেকক্ষণ পর নামায শেষ হলে মুসল্লীদের একজন মু’আযকে বলল, মুআয! অমুক আমাদের সাথে নামা
যে শরিক হয়েছে। আপনার দীর্ঘ কেরাতের কারণ নামায ছেড়ে চলে গেছে। এ কথা শুনে মু’আয (রা.) খুব নাখোশ হয়ে বলেন, তার মধ্যে নিফাক ও কপটতা আছে। আমি রাসূল (সা.)-কে তার বিষয়টি জানাবো। তারপর যুবকটিকে মুয়াযের এ মন্তব্য শোনানো হলে সে বলল আমিও যাবো রাসূল (সা.)-এর নিকট। মুআয়ের বিষয়টি রাসূলকে জানাবো। উভয়ে রাসূল (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হলেন। মুয়ায (রা.) যুবকটির আচরণ সম্পর্কে রাসূল (সা.)-কে অবহিত করেন।
তারপর যুবকটি বলল, হে রাসূল! তিনি দীর্ঘ সময় আপনার কাছে থাকার পর আমাদের এখানে আসেন। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে নামায পড়ান। আল্লাহর শপথ! হে রাসূল। মুয়ায নামায যে পরিমাণ লম্বা করেন, তাতে আমরা এশার নামায পড়তেই পারবো না।
রাসূল (সা.) মুআ’যকে বলেন, তুমি কী কেরাত পড়ে থাকো? মুআয একে একে সূরা বাকারাসহ বিভিন্ন সূরার নাম বলতে শুরু করেন। রাসূল (সা.) বুঝতে ■ পারলেন, মুয়াযের দীর্ঘ কেরাতই মানুষকে নামায হতে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। নয়তো নামায কী করে মানুষের ওপর কঠিন হতে পারে! তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন। মুআযকে বলেন, মুয়ায! তুমি কী মানুষকে ফিতনায় ফেলে দিতে চাও?
আমি বলব, তোমার এ কাজ মানুষের মধ্যে ফিতনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। এবং তাদেরকে দ্বীন হতে বিমুখ করবে। এক্ষেত্রে তুমি সূরা তারিক, সূরা বুরূজ সূরা শামস, সূরা লায়ল-এর মত সূরাগুলো পড়বে। তারপর রাসূল (সা.) যুবকটি দিকে তাকিয়ে কোমল স্বরে জানতে চাইলেন, ভাতুষ্পুত্র! তুমি নামায কীভাবে পড়ো? এমনিভাবে তখন যুবক বলল, আমি সূরা ফাতিহা পড়ি ও নামায শেষে আল্লাহ যুবকটির স্মরণ হলো, সে আল্লাহর রাসূল ও মুআযকে দীর্ঘ সময় ধরে দোয় করতে দেখে।
এজন্য সে বলল, আমি বুঝি না, আপনি ও মুআয এত দীর্ঘ সময় কী দোয়া করেন? আমি এত দীর্ঘ সময় কী দোয়া করব বুঝি না। কিছুদিন পরই এক যুদ্ধে এ যুবক বীর বিক্রমে লড়াই করে শাহাদাত বরণ করে রাসূল (সা.) এ খবর শোনার পর মুআযকে বলেন, তোমার ও আমার সেই বিবাদী যাকে তুমি মুনাফিক বলে কী করেছে শুনেছো? তখন মু’আয (রা.) বলেন, হে রাসূল। মহান আল্লাহ সত্য বলেন, আমি মিথা বলেছি। তিনি আল্লাহর পথে শাহাদাত বরণ করেন।
মানুষের স্বভাব ও অবস্থানের ভিন্নতার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। আর দেখুন ব্যক্তি বিবেচনায় রাসূল (সা.) আচরণে কেমন বৈচিত্র ও ভিন্নতা এনেছেন। ওসাবা বিন যায়দের সাথে রাসূল (সা.)-এর আচরণ। সেই ওসামা, যিনি রাসূল (সা.)-এর বড় আদরের, যিনি লালিত-পালিত হয়েছেন নবিগৃহে। একবার রাসূল (সা.) একবার জুহাইন গোত্রের শাখা আল হুরাকা এর উদ্দেশে সাহাবায়ে কেরামের একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। ওসাবা বিন যায়দও মুজাহ্নি ছিলেন। প্রত্যুষে যুদ্ধ আরম্ভ হলো।
মাহিনীতে মুসলমানগণ বিজয় লাভ করেন আর শত্রুবাহিনীর যোদ্ধারা পালাতে শুরু করেন শত্রুবাহিনীর এক যোদ্ধা ন্যয়ক্ষণ বীর-বিক্রমে লড়াই করছিল। সুতরাং সহযোদ্ধাদের পরাজিত হতে দেখে সে অস্ত্র ফেলে পলায়নে উদ্যত হলো ওসামা ও একজন আনসারী সাহাবি তার পিছু নিলেন। লোকটি দৌড়াচ্ছে তারা পিছু পিছু ধাওয়া করেন। প্রচন্ড ঘাকড়ে গিয়ে লোকটি একটি গাছে পেছনে আত্মগোপন করল। তখন ওসামা ও আনসারি সাহাবি তাকে ঘিরে ফেলে তরবারি উঁচিয়ে ধরলেন দুদিক থেকে মাথার ওপর উদ্যত চকচকে দুটি তরবারির মাঝে সে যেন মৃতুন ছায়া দেখতে পেলো।
মুখের শেষ আর্দ্রতাটুকু দিয়ে শুষ্ক জিহ্বাকে কোনো রকমে ভিজিয়ে অত্যন্ত ভয়ে সে বারবার বলতে শুরু করে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লা ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আমি সাক্ষ্য নিচ্ছি মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। এক পর্যায়ে আনসারি সাহাবি ওসামা কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। লোকটি আসলেই ইসলাম গ্রহণ করেছে, নাকি এটি আত্মরক্ষার নিছক কৌশলমাত্র?
যুদ্ধের ময়দান, পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ, কর্তিত হাত-পা। চারপাশে নিহতদের রক্তবন্যা, আহতদের আর্তচিৎকার। চোখের সামনে শত্রু। উভয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তড়িৎ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যে কোনো সময় গায়ে বিধতে পারে শত্রুতীর বা লক্ষ্যভ্রষ্ট তীর। তখন স্থির মাথায় চিন্তা করার মত সুযোগ ছিল না। আনসারি সাহাবি আঘাত না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তরবারি সরিয়ে নিলেন, আর ওসামা ধারণা করেন, এটা শত্রুর একটা কৌশল তরবারির আঘাতে তিনি লোকটিকে হত্যা করে ফেললেন।
মুজাহিদ বাহিনী মদিনায় ফিরে এলো। সকলের হৃদয়ে বইছে বিজয়-আনন্দের ফাল্গুধারা। উসামা (রা.) রাসূল (সা.)-কে যুদ্ধের ঘটনা শোনাতে শুরু করেন। প্রসঙ্গক্রমে সেই লোকটির কথাও এলো। রাসূল (সা.) আনন্দচিত্তে মুসলমানদের যুদ্ধজয়ের কাহিনী শুনছিলেন। ওসামা যখন বলেন, তারপর আমি তাকে হত্যা করলাম, সাথে সাথে রাসূল (সা.)-এর চেহারার রঙ বদলে যায়। রাসূল (সা.) বলেন, লোকটি কালিমা পড়া সত্ত্বেও তুমি তাকে হত্যা করলে? উসামা (রা.) বলেন, হে রাসূল! সে আন্তরিকভাবে কালিমা পড়েনি।
সে তা পড়েছিল আত্মরক্ষার্থে। তখন রাসূল (সা.) আবার বলেন, লোকটি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার পরও তুমি তাকে হত্যা করলে?! তুমি কেন তার বক্ষ বিদীর্ণ করে দেখলে না, সে আত্মরক্ষার্থে কালিমা পড়ছে কিনা?! রাসূল (সা.) উসামা (রা.)-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, লোকটি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার পরও তুমি তাকে হত্যা করলে?! লোকটি কালিমা পড়া সত্ত্বেও তাকে মেরে ফেললে?
কিয়ামতের দিন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ যখন তোমার বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে মামলা দায়ের করবে তখন কী পরিস্থিতি হবে? সেই প্রেক্ষাপটে বারবার রাসূল (সা.) ওসামাকে এ কথা বলছিলেন। ওসামা বলেন, রাসূল (সা.) আমাকে এতবার কথাটি বলেন, যে আমি ভাবছিলাম, যদি আমি আগে মুসলমান না হয়ে যদি ওই দিন মুসলমান হয়ে যেতাম।
একটি অভিমত
সব মানুষকে এক পাল্লায় ওযন করবেন না। মানুষের মনের যে কত রং, সেটা পরিমাপ করা অসম্ভব।
No Comment! Be the first one.