প্রতিটি চিন্তাশীল ব্যক্তি তার অভিষ্ট লক্ষ অর্জনের জন্যে কাঙ্ক্ষিত বস্তু অর্জনের জন্য বিভিন্ন কৌশল করে থাকে। সম্পদ অর্জনে ব্যস্ত ব্যক্তি নানান পন্থায় মন জয়ের শত পন্থা অর্থোপার্জন ও সমৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন রকমের পদ্ধতি অবলম্বন অবলম্বন করে থাকে। ব্যবসা-মুনাফা অর্জনের জন্যে বিভিন্ন কলা-কৌশলও নৈপুণ্যতা শিখতে চেষ্টা করে। এমনিভাবে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো মানুষের মন কাড়ার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে সচেষ্ট।
নানা ধরণের অনুষ্ঠান পরিচালনা করে ও নিত্য নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে। তারা দক্ষতার নিকট এমন এমন নতুন অনুষ্ঠান আবিষ্কার করে, যেগুলোর কারণে মানুষ তাদের অনুসরণ করতে বাধ্য হয়। একই কথা প্রযোজ্য প্রিন্ট মিডিয়া ও বেতারের ক্ষেত্রেও। ঠিক তেমনই পণ্য হালাল হোক বা হারাম, সেই পণ্যকে বাজারজাত করার জন্যে বৈচিত্রময় বিভিন্ন কৌশল করে থাকে। বিশেষ করে প্রত্যেকেই চায় যে সকল দক্ষতা অর্জন করলে তার কাঙ্ক্ষিত কর্মক্ষেত্রে তারা উন্নতি করতে পারবে সে সকল দক্ষতা অর্জন করতে এবং সেগুলোকে কাজে লাগাতে দৃঢ় তৎপর।
মানুষের হৃদয়ের ভালোবাসা অর্জন করা একটি শাস্ত্র। এর আছে নানা শেনী, বিভিন্ন পদ্ধতি বা কৌশলনীতি। আপনি একটি মজলিসে উপস্থিত হলেন। সেখানে প্রায় চল্লিশজন মানুষ আগে থেকেই আছেন। আপনি ঘুরে ঘুরে তাদের সাথে মোসাফাহা করতে শুরু করেন।
প্রথমে একজনকে সালাম করে তারে দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। সে নিরাসক্ত ভাব নিয়ে কোনো মতে হাতের একাংশ এগিয়ে দিলো এবং নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললাম স্বাগতম! স্বাগতম! আপনি দ্বিতীয়জনের কাছে গেলেন। সে তার পাশের একজনের সাথে কথা বলছিলেন। আপনি গিয়ে হঠাৎ তাকে সালাম দিলেন। সেও নিরুত্তাপ কণ্ঠে সালামের জবাব দিলো এবং আপনার দিকে না তাকিয়েই মোসাফাহা করল।
তৃতীয়জন তার মোবাইলে কথা বলায় ব্যস্ত ছিল। আপনি সালাম দেয়ায় সে হাত বাড়িয়ে দিলো। তবে অভ্যর্থনামূলক কিছু বলল না, আপনার প্রতি আগ্রহও দেখালো না। চতুর্থজন আপনাকে আসতে দেখেই সালাম দেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে যায়। চোখে চোখ পড়তেই হাসিমুখে আপনার সাথে কথা বলল ও আনন্দ প্রকাশ করল। আপনার সাথে সাক্ষাতে সে বেশ আনন্দিত, তাও বোঝালো। উষ্ণতার নিকট আপনার সাথে মোসাফাহা করল ও আপনার আগমনে সন্তুষ্টি প্রকাশ করল।
অথচ না আপনি তাকে চেনেন, না সে আপনাকে চেনে। আপনি সকলের সাথে সালাম ও সাক্ষাত পর্ব শেষ করেন। আল্লাহর শপথ দিয়ে আপনাকে জিজ্ঞেস করছি, বলুন এ চতুর্থ লোকটির প্রতি কি আপনি ভিন্ন রকম আকর্ষণবোধ করবেন না? এটা স্বাভাবিক আপনার মন তার প্রতি আকৃষ্ট হবে। আপনি তা টেরও পাবেন না। বাস্তবতা হলো, আপনি তার নামও জানেন না, সে কোথায় কাজ করে, কী তার পেশা-কিছুই জানেন না। তা সত্ত্বেও সে আপনার হৃদয়রাজ্য জয় করে নিয়েছে।
এটা কোনো সম্পদ বা পদের মাধ্যমে হয়নি। হয়নি বংশ-মর্যাদার জন্যে। এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে তার শুধুমাত্র মানুষের সাথে আচরণদক্ষতায় অভিজ্ঞ হওয়ার কারণে। শক্তি-সম্পদ বা সৌন্দর্য ও পেশার গুণে মানুষের হৃদয় জয় করা যায় না। মানুষের হৃদয় তাছাড়া এর চেয়েও অনেক সহযে জয় করা যায়। তারপরও খুব কম মানুষই অন্যের হৃদয়রাজ্য জয় করে তার হৃদয়ের গভীরে স্থান করে নিতে পারে। এখনো আমার মনে পড়ে, কলেজের এক ছাত্র মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলো।
এতে সে বেশ কষ্ট পাচ্ছিলো। তার পিতা একজন উচ্চপদস্থ চাকুরীজিবী ছিলেন। তিনি বিভন্ন সময় কলেজে আসতেন আমার সাথে দেখা করতেন। আমিও তার সন্তানের চিকিৎসার জন্য সাধ্যমত সাহায্য করতাম। আমি মাঝে মাঝে তাদের বাড়িতে যেতাম। বাড়িটি দেখতে একটি চমৎকার প্রসাদের ন্যয়। দেখতাম, তার পিতার কামরায় সবসময় মেহমানদের এত ভিড়, সামান্য ফাঁকা জায়গাও নেই। মানুষ যে তাকে এত ভালোবাসে, তা দেখে আমি অবাক হাতাম।
এমনিভাবেই বহু বছর কেটে যায়। তিনি চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। একবার তার বাড়িতে গেলাম। সেই ঘরে প্রবেশ করলাম। কামরাটির দিকে তাকালাম। আর সেখানে পঞ্চাশটির অধিক চেয়ার পড়ে আছে। কামরায় কেউ নেই। বৃদ্ধ একা বসে বসে রিমোটটি পিছেন, আর বিভিন্ন অনুষ্ঠান শুনছেন। আর একজন সেবক মাঝে মাঝে তাকে চা, কফি দিয়ে যাচ্ছে। আমি সেখানে তার সেঙ্গ কিছুক্ষণ বসলাম।
বের হওয়ার পর আমি ভাবতে লাগলাম, তিনি যখন চাকুরীতে ছিলেন তখন তার কেমন অবস্থা ছিল আর তার বর্তমান অবস্থা কী? পূর্বে কেন মানুষ তার কাছে আসতো? কেন সকলে তার বাড়িতে ভিড় জমাতো? কেন বা তারা তাকে ভালোবাসতো? আমি তখন বুঝলাম, তিনি তার আচরণ-উচ্চারণ ও সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়রাজ্যকে জয় করতে পারেননি। মানুষ আসতো তার পদ ও গদমর্যাদার কারণে, ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণে; ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রগুণের কারণে নয়।
আজ পদ নেই, ভালোবাসাও নেই। ক্ষমতা নেই, এজন্য ভিড়ও নেই। আপনিও শিক্ষা নিন তার এমন ঘটনা হতে। ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রগুণে জয় করুন মানুষের হৃদয়। মানুষের সাথে এমন সুন্দর আচরণ করে যান তাহলে দেখবেন, যেন তারা আপনার ব্যক্তিত্বকে পছন্দ করে। তারা যেন আপনাকে ভালোবাসে আপনার ন আচরণ ও বিনয়ী উচ্চারণ, আপনার মায়াবী চাহনী ও মিষ্টি হাসির কারণে, অন্যের দোষ দেখলেও উপেক্ষা করে চলার দুর্লভ গুণের কাররেণ এবং অন্যের বিপদে-আপদে স্বতঃস্ফূর্ত পাশে দাঁড়ানোর মত গুণের কারণে।
তাদের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা যেন আপনার পদমর্যাদা ও ক্ষমতার কারণে না হয়। তাছাড়া তা যেন হয় আপনার প্রতি তাদের হৃদয়ের ভালোবাসার কারণে। যে ব্যক্তি তার স্ত্রী-সন্তানের অর্থ-সম্পদ, খাবার-দাবার সব চাহিদা দূর করে, সে তাদের উদরতুষ্টি অর্জন করতে পেরেছে, তাদের মনোতুষ্টি অর্জন করতে পারেনি। যে তার স্ত্রী-সন্তানকে প্রচুর অর্থ প্রদান করে, আবার তাদের সাথে খারাপ ব্যবহারও করে, সে তাদেরকে আর্থিকভাবে সন্তুষ্ট করতে পারলেও তাদের হৃদয়কে বশ করতে পারেনি।
আর তাতে মোটেও আশ্চর্য হবেন না যদি আপনি দেখেন, বিপদে পড়ে কোনে যুবক তার বন্ধু, মসজিদের ইমাম কিংবা শিক্ষকের শরণাপন্ন হয়েছে, নিজের বাবাকে জানায়নি, জানাতে পারেনি। এর কারণ হচ্ছে, তার বাবা তার হৃদয়কে জয় করতে পারেনি, ভাংতে পারেনি তার ও সন্তানের মাঝের অদৃশ্য বাঁধকে।
পক্ষান্তরে তার বন্ধু বা শিক্ষক তার হৃদয়কে জয় করতে পেরেছে। তারা হতে পেরেছে তার হৃদয়ের মানুষ। আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ভেবে দেখুন। কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে আপনি দেখবেন, তারা যখন কোনো মজলিসে উপস্থিত হয় এবং বসার জন্য জায়গা খুঁজতে থাকে, উপস্থিত সকলের মাঝে অদৃশ্য প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়ে যায়। সকলে তাকে ডাকতে থাকে, সকলে তাকে নিজের পাশে বসতে অনুরোধ করে। এবার বলুন, এমনটি কেন হয়েছে? কেন তার প্রতি সকলের এত ঝোঁক!
আপনি কি কখনো সুশৃঙ্খল বুফে রাতের খাবারের জন্য নিমন্ত্রন পেয়েছেন। বুফের নিয়ম হলো, প্রত্যেকে নিজ চাহিদা মত ডিশ থেকে নিজ নিজ প্লেটে খাবার নিয়ে নেবে। তারপর ওবাল আকৃতির কোনো একটি টেবিলে বসে খেতে থাকবে। সেখানে আপনি দেখেছেন, কেউ কেউ নিজ প্লেট পূর্ণ করা মাত্রই অনেকে তাকে ইশারা করে বলতে থাকে, এই যে ফাঁকা জায়গা আছে, এখানে বসুন। এই যে ফাঁকা জায়গা আছে, বসুন। প্রত্যেকেই চায়, সে তার নিকট বসুক।
অন্য একজন তার খাবার পূর্ণ করে নিচ্ছে, এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে, কেউ তাকে ডাকেও না; তার প্রতি কেউ ভ্রুক্ষেপও করে না। অবশেষে সে নিজেই কোন টেবিল খুঁজে নিয়ে সেখানে আসন গ্রহণ করে। আপনি আরো দেখবেন, কেন প্রথমজনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ, দ্বিতীয়জনের। প্রতি এতো অবজ্ঞা তিরষ্কার? আপনি বলুন, কিছু মানুষ দূরে-কাছে যেখানেই থাকুক না কেন? অন্তরে তাদের প্রতি আপনি ভিন্ন রকম মনের টান থাকে।
তখন মনে হয় যেন তাদের হাতে কোনো যাদুর কাঠি আছে, যার সাহায্যে তারা দূরে থেকেও টানতে থাকে। লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, তারা কীভাবে মানুষের হৃদয়কে আকৃষ্ট করতে পারেন? বিশেষ করে তাহলো বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করার কিছু দক্ষতা নেপুণ্যতা, যা প্রয়োগ করলে একজন মানুষ সকলের মনে জায়গা করে নিতে পারে।
প্রস্তাব:
অন্যের মনে জায়গা করে নিতে পারলে, প্রকৃত জীবন উপভোগ করা সম্ভব।
No Comment! Be the first one.