বাংলাদেশের অর্থনীতি পশ্চাৎপদ বা অনগ্রসর। এই পশ্চাৎপদতার জন্য দায়ী প্রধান কারণগুলো নিম্নে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল।
ব্রিটিশ শাসন ও শোষণ: বাংলাদেশের অর্থনীতির অনগ্রসরতার জন্য দায়ী ঐতিহাসিক কারণ হচ্ছে ২০০ বছরের বৃটিশ শাসন ও শোষণ। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই দু’শত বৎসরে বৃটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ (বিশেষত বাংলাদেশ) এর উন্নয়নে কোন কাজ করেনি এবং নানাভাবে শোষণ ও নির্যাতন করেছে। এই অঞ্চলে বৃটিশরা কোন শিল্প কারখানা গড়ে তোলেনি বরং এই অঞ্চলকে তারা তাদের দেশের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত করেছিল। কথিত আছে যে, এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী শিল্প কলকারখানা ধ্বংস করে এবং নানাভাবে সম্পদ লুণ্ঠন করে বৃটিশ শিল্প বিপ্লবের ভীত রচিত হয়েছিল। তার উপর ভিত্তি করেই আজকের আধুনিক ও শিল্পোন্নত যুক্তরাজ্য
পাকিস্তানী শোষণ : বাংলাদেশের অর্থনীতির অনুন্নতির আরেকটি ঐতিহাসিক কারণ হল পাকিস্তানের ২৫ বৎসরের লুটপাট, শোষণ ও শাসন। বৃটিশ শাসন থেকে ১৯৪৭ সালে মুক্ত হবার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) স্বাধীনতার নামে নতুন করে পরাধীন হয়ে পাকিস্তানের (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান) ঔপনিবেশে পরিণত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য তেমন কিছুই করেনি। বরং এই ২৫ বৎসরের শাসনকালে এই অঞ্চল থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা সুকৌশলে আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করেছে যার প্রভাব এখনও রয়ে গেছে। সেখান থেকে বাংলাদেশ এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি।
দক্ষ উদ্যোকার অভাব: একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য দরকার একদল দক্ষ ও প্রগতিশীল উদ্যোক্তা। বাংলাদেশে দক্ষ উদ্যোক্তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশের সম্পদ সীমিত। তার উপর এই সীমিত সম্পদকে দক্ষভাবে ব্যবহার করার জন্য যে একদল দক্ষ উদ্যোক্তার প্রয়োজন তা বাংলাদেশে নেই। দক্ষ উদ্যোক্তার অভাবে বাংলাদেশের সীমিত সম্পদকে দক্ষভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
সুশাসনের অভাব/দুর্নীতি: সুশাসনের অভাব বা দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের অর্থনীতির অনুন্নতির অন্যতম প্রধান কারণ। লজ্জাজনক হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছর ধরে পরপর দুর্নীতিতে বিশ্বের শীর্ষ পদ ধরে রেখেছে। দুর্নীতির কারণে এদেশের সরকারের অনেক ভাল উদ্যোগ। এবং অর্জন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করে সেদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক শান্তি-শৃংখলার উপর। কিন্তু স্বাধীনতার পর বিগত ৪০ বছরে বাংলাদেশে কখনও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল না। বরং হরতাল, ধর্মঘট, বিক্ষোভ, সংসদ বর্জন, হত্যা ইত্যাদি নানারকম রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কাঙ্খিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
অনুন্নত অবকাঠামো: একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে অবকাঠামো কিন্তু বাংলাদেশের অনুন্নত অবকাঠামো এদের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার প্রধান কারণ। বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম, ঘনঘন লোডশেডিং, গ্যাস সংকট, পরিবহণ ও যোগাযোগের সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করছে।
মূলধনের অভাবঃ মূলধনের অভাব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অনুন্নতির প্রধান কারণ। মূলধনের স্বল্পতার কারণে বিনিয়োগ কম, কর্মসংস্থান কম এবং উৎপাদন কম। এজন্য অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দারিদ্রের দুষ্টচক্র এবং নিম্ন আয়স্তরের ভারসাম্য ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।
অনুন্নত কৃষি: বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। অথচ কৃষিতে উৎপাদন ও চাষব্যবস্থা খুবই অনুন্নত। আধুনিক চাষাবাদের পরিবর্তে কৃষিতে এখনও সেকেলে/সনাতন চাষ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত বীজ ও সার এর ব্যবহার এখনও সার্বিকভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তাই বাংলাদেশের কৃষিতে একর প্রতি ফলনও খুবই কম। অর্থনীতির এই প্রধান খাতের অনগ্রসরতাই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সামনে এগোতে বাধা দিচ্ছে।
প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশ: বাংলাদেশের জনগণের দৃষ্টিভঙ্গী এখনও পুরানো ধাঁচের। বেশীরভাগ মানুষ সামাজিক কুসংস্কার ও বিভিন্ন গোঁড়ামীতে বিশ্বাস করে। এই প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অনুকুল নয়। বর্ণ প্রথা, বাল্য বিবাহ, যৌথ পরিবার প্রথা ইত্যাদি বিপুল সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে অনগ্রসর করে রেখেছে।
বেকারত্বঃ বাংলাদেশে বর্তমানে মোট শ্রমশক্তির এক তৃতীয়াংশ বেকার রয়েছে। তাছাড়া কৃষিতে কম বেকারত্ব এবং মৌসুমী বেকারত্বও রয়েছে। এই বিপুল বেকার জনগোষ্ঠীর চাপ বাংলাদেশকে অনুন্নত করে রাখতে অনেকটাই দায়ী।
অসম আয় বণ্টন : বাংলা শের সম্পদ ও পুঁজির বিরাট অংশ মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকায় প্রায় ৪০% এর বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করে, দিনে আনে দিনে খায়।
এদেশের প্রায় ৯০ ভাগ সম্পদের মালিক মাত্র মুষ্টিমেয় কিছু লোক। আর বাকী ১০ ভাগ সম্পদের মালিক হচ্ছে ৯০ ভাগ মানুষ। এই ধারণা থেকেই পরিষ্কার বাংলাদেশে আয় বন্টনে অসমতা বা বৈষম্য কতটা প্রকট। আয় বণ্টনে এরূপ অসমতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অনুন্নতির জন্য কম সায়ী নয়।
অনুন্নত শিল্পঃ শিল্পক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও অনুন্নত। মূলধনের অভাব, প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির অভাব, দক্ষ শ্রমিক ও দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশে শিল্পায়ন হচ্ছে না। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের শিল্প উন্নয়নের জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাংখিত শিল্পোন্নয়ন হয়নি। তেমন কোন ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠা হয়নি। যে সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোতেও আধুনিক প্রযুক্তিগত উৎপাদন ব্যবস্থা পুরোদমে চালু হয়নি। শিল্পক্ষেত্রে এই দুরাবস্থা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার জন্য অনেকটাই দায়ী।
অশিক্ষিত ও অসচেতন জনগণ: বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ এখন অশিক্ষিত। ২০১১ সালের হিসাবেও দেখা যায় বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ এখনও অশিক্ষিত এবং অসচেতন। জনগণের অশিক্ষা ও অসচেতনার কারণে সকল জনগণকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে না, তাই বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে রয়েছে।
প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রচুর ফসল বিনষ্ট হয় এবং ঘরবাড়ী ও অন্যান্য সম্পত্তি ধ্বংস হয়। অনেক পরিশ্রমে উৎপাদিত ফসল মাত্র কয়েক মিনিটের ঝড়ের তান্ডবে ধ্বংস হয়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার একটা অন্যতম কারণ।
প্রাকৃতিক সম্পদের অসম্পূর্ণ ব্যবহার: এমনিতেই বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ অপর্যাপ্ত। তারপরেও উপযুক্ত নীতির অভাব, কারিগরী জ্ঞানের অভাব এবং মূলধনের স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে পরিপূর্ণ ও দক্ষভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের অদক্ষ ও অপূর্ণ ব্যবহার এদেশকে অনুন্নত ও অনগ্রসর করে রেখেছে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে ইহা সুস্পষ্ট যে, দীর্ঘদিনের সমস্যা এবং তা সমাধানের ক্ষেত্রে সাফল্যের অভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি দুষ্টচক্রে আবর্তিত হচ্ছে। এর অনিবার্য ফলস্বরূপ এদেশের অর্থনীতি অনগ্রসর ও পশ্চাৎপদ বয়ে গেছে।
No Comment! Be the first one.