মানুষের সবথেকে মূল্যবান সম্পদ হলো মার্জিত আচরণ ও সুন্দর ব্যবহার। তাই আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন, সর্বদা সবার সাথে সে সর্বময় নম্র, ভদ্র, বিনয়ী ও সহনশীল একজন মানুষ। জীব-জন্তু জড় বস্তুর সাথেও তার আচরণ হয় কোমল। রাসূল (সা.)-এর সাহাবাদের সাথে একবার সফরে ছিলেন। মুসলমানরা এক জায়গায় এসে ছাউনি ফেললেন। পথিমধ্যে তিনি কিছু সাহাবীর হাতে একটি পাখির বাসা দেখেন। বাসায় দুটি ছানা। পাখির ছানাদুটি তারা ধরে আটকে রেখেছে।
মা পাখিটা তাদের চারপাশে ওড়াউড়ি করছে আর ডানা ঝাপটাচ্ছে। রাসূল (সা.) এ অবস্থা দেখে সাহাবায়ে কেরামকে বলেছেন, ছানা দুটি আটকে রেখে মা পাখিটাকে কষ্ট দিচ্ছো কেন? এক্ষুণি ছানা দুটিকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দাও। আরেকবার রাসূল দেখেন, পিপীলিকার একটি বাসা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তিনি বলেন, কে এটি পুড়িয়েছে? সাহাবি বলেন, আমি হে রাসূল! রাসূল (সা.) অসন্তুষ্ট হয়ে বলেন, আগুন দ্বারা শাস্তি দেয়ার অধিকার শুধুমাত্র তার, যিনি আগুনের প্রতিপালক।
এক আল্লাহ ছাড়া আগুন দিয়ে পোড়ানোর অধিকার কারো নেই। রাসূল (সা.) ছিলেন উদারতার প্রতীক। নিরীহ প্রাণীকুলের প্রতিও তিনি সীমাহীন উদার ছিলেন। একবার তিনি ওযু করছিলেন। এ অবস্থায় একটি বিড়াল এলো। রাসূল (সা.)-এর মনে হলো, বিড়ালটির পিপাসা লেগেছে। তিনি পানির পাত্রটি বিড়ালের সামনে ঝুঁকিয়ে দিলেন। বিড়ালটি পানি পান করল। অবশিষ্ট পানি দিয়ে নবিজী ওযু শেষ করেন। একবার রাসূল (সা.) কোথাও যাচ্ছিলেন।
পথিমধ্যে এক ব্যক্তিকে দেখেন ৭ মাটিতে একটি বকরী শুইয়ে রেখেছে। একদিকে সে বকরীটার ঘাড়ে পা দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে, অন্যদিকে যবাই করার জন্য ছুরি ধার দিচ্ছে, আর বকরীটি করুণ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর এ অবস্থা দেখে নবিজী খুব রাগ করেন।
বলেন, তুমি কি বকরীটিকে দুবার মারতে চাও? শোয়ানোর আগে ছুরিটা ধার করে। নিলে না কেন? একবার রাসুল (সা.) দু’জন ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি দেখেন, তারা উভয়ে নিজেদের উটনীর উপর বসে পরস্পর কথা বলছে। এ অবস্থা দেখে উটনী দুটির প্রতি রাসূল (সা.) খুব মায়া হলো। তাই তিনি পশুকে চেয়ার বানিয়ে বসতে নিষেধ করেন। তখন প্রয়োজনের সময় উটনীর ওপর আরোহণ করবে। তবে প্রয়োজন শেষে হলে নেমে যাবে। পশুটিকে আরামে ছেড়ে দিবে।
আল্লাহর রাসূল পশুর কপালে দাগ দিতেও নিষেধ করেন। রাসূল (সা.) একটি উটনী ছিল। উটনির নাম ছিল আযবা। মুশরিকদের একটি দল একবার মুসলমানদের উটের ওপর হামলা করে বসলো। উটগুলো মদিনার উপকণ্ঠে বিচরণ করছিল। মুশরিক দল সেগুলো নিয়ে যায়। রাসূল (সা.) উটনীও এর মধ্যে ছিল। একজন মুসলিম নারীকেও তারা বন্দী করে নিয়ে যায়। তখন বন্দিনী মুসলিম নারী ও উটগুলো নিয়ে তারা পালিয়ে যায়। পথিমধ্যে বিশ্রামের জন্য এক স্থানে থেমে উটগুলো মাঠে ছেড়ে দিয়ে তারা একটি ঘরে ঘুমিয়ে পড়লো।
এদিকে গভীর রাতে বন্দিনী মহিলা পলায়নের প্রস্তুতি নিলেন ও আরোহণের জন্য একটি উটের দিকে অগ্রসর হলেন। কাছে আসা মাত্রই উটটি জোরে হাঁক দিলো। মহিলা সেখান থেকে সরে গেলেন। পর্যায়ক্রমে তিনি সকল উটের কাছে যান। সবগুলোই অশান্ত হয়ে ডাকাডাকি আরম্ভ করলো। শেষ পর্যন্ত তিনি আযবা নামক উটনীর কাছে এসে দেখেন, সেটি একেবারে নম্র ও শান্ত। বন্দিনী মহিলা তাতে সওয়ার হয়ে মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। উটনীও খুব দ্রুত গতিতে ছুটে চললো। বিপদ কেটে মুক্ত হাওয়া গায়ে লাগতেই মহিলা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন।
আবেগভর কন্ঠে বলেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার জন্য এই উটনীটি কুরবানী করব। মহিলা মদিনায় পৌঁছলে লোকজন রাসূল (সা.)-এর উটনীটি নিয়ে যায়। সকলে উটনী নিয়ে রাসূল (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হলো। অপরদিকে মহিলাও উটনী খুঁজতে শুরু করেন। সংবাদ পেয়ে তিনিও রাসূল (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হলেন। রাসূলকে জানালেন, তিনি এটাকে কুরবানীর মান্নত করে ফেলেন। এমন পরিস্থিতিতে রাসূল (সা.) বলেন, এ কেমন কথা। এ কেমন প্রতিদান। এং মাধ্যমে আল্লাহ তোমাকে নাজাত দিলেন। এর বিনিময়ে এটাকেই তুমি জবাই করতে চাচ্ছো? কী নিকৃষ্ট প্রতিদান। রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহর অবাধ্যতা হয় এমন মান্নত সমস্ত করতে নেই। অন্যের সম্পদ সংশ্লিষ্ট মান্নত পূর্ণ করতে নেই।
আপনি কেন আপনার সহজাত দক্ষতাগুলোকে সার্বক্ষণিক গুণে পরিণত করবেন না? নম্রতা ও কোমলতা, ভদ্রতা ও উদারতা, দয়া ও মানবিকতা এসব সুমহান গুণাবলীকে কেন সব ক্ষেত্রে সবার সাথে প্রয়োগ করবেন না? এগুলোর সৌরভ ছড়িয়ে দিন মানুষের মাঝে, প্রাণীকুল ও জীবজন্ত্রর মাঝে। এমনকি গাছপালা, তরু-লতা ও জড়বস্তুরও মাঝে। একবার রাসূল (সা.) জুমার দিন মসজিদে রাখা একটি খেজুর গাছে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন।
হঠাৎ করে এক আনসারী মহিলা বলেন, হে রাসূল! আমার এক ক্রীতদাস কাঠমিস্ত্রি। আপনি অনুমতি দিলে তাকে দিয়ে আপনার জন্য একটি মিম্বর বানিয়ে দিতাম। রাসূল (সা.) বলেন, ঠিক আছে, বানিয়ে দাও। এরপর মহিলা সাহাবি একটি মিম্বর তৈরি করলেন। পরবর্তী জুমার দিন রাসূল (সা.) সেই নতুন বানানো মিম্বরে আরোহণ করেন। যখন তিনি আরোহন করেন। এদিকে মিম্বরে বসতেই খেজুরকান্ডটি ষাঁড়ের ন্যয় আওয়াজ করে উচ্চ স্বরে কাঁদতে শুরু করেন। মনে হলো সেটা ফেটে যাবে।
তখন মসজিদ যেন কেঁপে উঠলো। রাসূল (সা.) মিম্বর থেকে নেমে গাছটিকে বুকে জড়িয়ে নেন। তখন সেই খেজুরকান্ডটি শিশুর মতো ক্রন্দনরত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে শান্ত ও নীরব হয়ে যায়। হাদীসের এক বর্ণনামতে, রাসূল (সা.) বলেছেন, যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ! যদি আমি খেঁজুরকা-টিকে জড়িয়ে না ধরতাম তাহলে কেয়ামত পর্যন্ত সেটি ক্রন্দন করত।
ইঙ্গিতে:
আল্লাহ পৃথিবীর সবথেকে মানুষকে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান বানিয়েছেন, তার মানে এই নয়, মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির উপর জুলুম করতে পারবে।
No Comment! Be the first one.