একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা হচ্ছে রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া। যেটা শরীরে পর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকা বা হিমোগ্লোবিনের অভাবে দেখা দেয়। আমরা জানি যে, হিমোগ্লোবিনের প্রধান কাজ হচ্ছে রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করা।
কিন্তু যখন ঠিকমতো অক্সিজেন সরবরাহ হয় না, তখন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। যা স্বাভাবিকভাবেই রক্তশূন্যতাকে ইঙ্গিত করে। তবে সহজেই ঘরে বসে এটা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব, কারণ চোখের পাতার রং দেখে আপনার রক্তশূন্যতা হয়েছে কিনা সেটা বুঝতে পারবেন।
চোখের পাতার রং দেখে রক্তশূন্যতা বোঝা
বর্তমানে রক্তশূন্যতা লক্ষণ বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে চোখের পাতার রং। সাধারণত বাইরের অংশ উজ্জ্বল লাল রং ধারণ করে, যার মাধ্যমে সঠিক মাত্রা বুঝা যায়। কিন্তু যদি কারো রক্তশূন্যতা হয় তাহলে তার চোখের বাইরের অংশের লাল রং কমে যায় এবং এর পাশাপাশি চোখের ভেতরের আরো ফ্যাকাসে বা হালকা গোলাপি হয়ে যায়।
অর্থাৎ রঙ্গের উজ্জ্বল লাল পার্থক্য যদি না থাকে, মানে চোখের পুরো অংশই যদি ফ্যাকাসে বা হালকা গোলাপি দেখা যায় তাহলে তা রক্তশূন্যতার একটি পরিস্কার লক্ষণ।
কেন রক্তশূন্যতা চোখের পাতায় প্রভাব ফেলে?
আমাদের শরীরে যখন রক্তশূন্যতার কারণে পর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকা থাকে না, তখন শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছায় না। তাছাড়া চোখের পাতার অভ্যন্তরের অংশটি খুবই সংবেদনশীল এবং এর পাশাপাশি রক্ত প্রবাহের ওপর সরাসরি নির্ভরশীলও।
শরীরে কোন ভাবে যদি অক্সিজেনের অভাব হয়, তাহলে চোখের এই অংশটি ফ্যাকাসে হয়ে পড়ে। অর্থাৎ হিমোগ্লোবিনের কারণে চোখের পাতার রঙে পরিবর্তন আসতে পারে, এবং এটাকে আমরা রক্তশূন্যতার প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করি।
রক্তশূন্যতার অন্যান্য লক্ষণ গুলো
চোখের পাতার রং পরিবর্তনের পাশাপাশি রক্তশূন্যতার, আরো কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে। যা রক্তশূন্যতার ইঙ্গিত দেয়। নিচে এগুলো উল্লেখ করা হলো:
১. শরীর অস্বাভাবিকভাবে ক্লান্ত হওয়া। হিমোগ্লোবিনের অভাবে শরীরে অক্সিজেন কম পৌঁছায়। যার কারণে শারীরিক শক্তি হ্রাস পায়।
২. অতি সাধারণ কাজও করতে কষ্ট হয়। অর্থাৎ হালকা কাজেও শ্বাসকষ্ট বা দুর্বলতা অনুভব হতে পারে।
৩. হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পাওয়া। অক্সিজেনের অভাব হলে, আমাদের শরীরে হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে যায়।
৪. মাথা ঘুরানো বা বমি বমি ভাব। শরীরে অক্সিজেনের অভাব হলে, আমাদের মস্তিষ্কেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৫. হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া। রক্তশূন্যতার কারনে আমাদের হাত ও পায়ে রক্ত চলাচল কমে যায়।
শরীরের যেসব কারণে রক্ত শূন্যতা দেখা দেয়
রক্তশূন্যতার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে সেজন্য সঠিকভাবে এসব কারণগুলো চিহ্নিত করে সঠিক চিকিৎসা করতে হবে। নিচে কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো :
১. আমাদের শরীরে পর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকার অভাব হলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।
২. শরীরে আয়রনের ঘাটতি হলে। অর্থাৎ শরীরে হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে আইরন সাহায্য করে। শরীরে আয়রনের ঘাটতি হলে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন না থাকলে হয়ে থাকে।
৩. ভিটামিন বি১২ এবং ফলিক অ্যাসিডের অভাবে, আমাদের শরীরে লোহিত রক্তকণিকা ঠিকমতো তৈরি হয় না।
৪. তাছাড়া যে কোনো বড় বা ছোট রক্তপাতের কারণে রক্তশূন্যতা হতে পারে। বিশেষ করে মহিলাদের মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে, রক্তশূন্যতার অভাব দেখা দিতে পারে।
৫. এছাড়া বংশগত কারণে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। যেমন: থ্যালাসেমিয়া বা সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার মত কিছু বংশগত রোগের কারণে রক্তশূন্যতার হতে পারে।
কিভাবে রক্তশূন্যতার পরীক্ষাগুলো করবেন?
যদি কারো চোখের পাতার রং ফ্যাকাশে হয়ে যায় বা রক্তশূন্যতার উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে অবশ্যই দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। অর্থাৎ চিকিৎসক অসাধারণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে রক্তশূন্যতা নির্ণয় করতে পারেন। নিচে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরীক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করা হলো:
১. পূর্ণরক্ত পরীক্ষা যেটাকে ( CBC ) বলা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ এবং লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা জানতে পারবেন।
২. ফেরিটিন পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে আয়রনের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়।
৩. ভিটামিন বি১২ এবং ফলিক এসিড পরীক্ষার মাধ্যমে আমাদের শরীরে ভিটামিনের ঘাটতি আছে কিনা সেটা জানতে পারবেন।
৪. থ্যালাসেমিয়া বা সিকল সেল অ্যানিমিয়ার মতো বংশগত রোগ নির্ধারণের জন্য অবশ্যই জিনগত পরীক্ষা করাতে হবে।
কিভাবে রক্তশূন্যতার প্রতিরোধ ও চিকিৎসা করাবেন?
শরীরে রক্তশূন্যতার নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা নির্ভর করে এর কারণ এর উপর। তবে চিন্তার কোন বিষয় নেই, কারণ সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে রক্ত শূন্যতা প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
এজন্য অবশ্যই আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। যেমন: মাংস, কলিজা, ডিম, পালং শাক এবং ডাল ইত্যাদি। তাছাড়া আয়রন শরীরে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে।
এর পাশাপাশি আপনাদেরকে অবশ্যই ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। কারণ ভিটামিন সি আয়রনের শোষণ বাড়াতে সহায়ক। যেমন : লেবু, কমলা এবং টমেটো খাওয়া।
শরীরে ভিটামিন বি১২ এবং ফলিক এসিডের ঘাটতি পূরণের জন্য দুধ, ডিম এবং শাকসবজি খাওয়া উচিত। আর যদি খাদ্যা ভাসে আয়রনের ঘাটতি থেকে যায়। তাহলে ডাক্তারের পরামর্শে আইরন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে।
তাছাড়া যদি রক্তশূন্যতার কারণ হিসেবে বড় কোন রোগ নির্ণয় হয়, তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
শেষ কথা
অতিরিক্ত চিন্তিত হবে না কারণ রক্তশূন্যতা হচ্ছে একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, যা সহজে নির্ণয় এবং প্রতিরোধ করা সম্ভব। অর্থাৎ চোখের পাতা রং পরিবর্তন রক্তশূন্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, যা আপনি নিজেই পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। তবে অবশ্যই সঠিকভাবে জানার জন্য এবং সঠিক চিকিৎসার জন্য দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। আর এর পাশাপাশি সঠিক খাদ্যাভাস, নিয়মিত পরীক্ষা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
No Comment! Be the first one.