মাঝে মাঝে দেখা যায় কোন মজলিসে দু’জন লোক বিতর্ক করে আর প্রচ- তর্কের মধ্যে দিয়ে কথা শেষ হলো। বিশেষ করে এমন দুজনকেও দেখা যায়, যাদের বিতর্ক সমাপ্ত হয় সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে এবং হাসিমুখে। এমন কেন হয়? মূলত এখানে রয়েছে কথা বলার দক্ষতা নৈপুণ্যতা ও যোগ্যতার পার্থক্যের কারণেই তা হয়ে থাকে।
আপনি লক্ষ করলে দেখবেন, দুজন বক্তা একই বিষয়ে বয়ান করেন। একজনের বয়ান চলার সময় উপস্থিত লোকজন ঘুমায়, নয়তো তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আবার কেউ কেউ কিছুক্ষণ এদিক সেদিক তাকিয়ে উঠে চলে যায়। অপরজনের বয়ানের সময় দেখা যায়, শ্রোতারা বিমুগ্ধ ও সতর্ক হয়ে তার আলোচনা শোনে। গভীর দৃষ্টিতে বক্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর কারোর চোখের পলকও পড়ে না। আর কেউ ঘুমায় না। কেউ কথা বললে তাতে বিরক্তি প্রকাশ করে।
এমন কেন হয়ে থাকে? কেন একজনের আলোচনার সময় থাকে নীরব, পলকহীন দৃষ্টি, অখ- মনোযোগ আর অন্যজনের আলোচনার সময় বিক্ষিপ্ত নড়াচড়া, পরস্পর কথাবার্তা বা মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠে মগ্নতা? বক্তৃতার পার্থক্যের কারণে এমন হয়।
কিছু কিছু শিক্ষকের বেলায়ও এমনটি হয়ে থাকে, যখন তিনি মাদরাসার বারান্দায় হাঁটেন তখন ছাত্ররা জটলা তাকে ঘিরে ঘরে। কেউ মোসাফাহ করে হাত বাড়িয়ে দেয়, আবার কেউ পরামর্শ চায়। আবার কেউ কোনো প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়। এমনিভাবে তিনি নিজ দফতরে বসে ছাত্রদের আসার অনুমতি দিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত কামরা ছাত্রে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। অথচ অন্য অনেক শিক্ষক আছেন, পথে হাঁটলে কেউ তার সাক্ষাতে এগিয়ে আসে না। হাঁটেন একা, মসজিদ থেকে বের হন একা।
আবার কিছু কিছু শিক্ষকের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়ে থাকে, কেউ কেউ হাসিমুখে এগিয়ে এসে তাকে সালাম দেয় না। পরামর্শ চাইতেও কেউ তার নিকট আসে না। রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা দফতরে বসে থাকলেও কেউ তার নিকট দেখা করতে আসে না। এমনটি কেন হয়ে থাকে? মানুষের সাথে মেলা-মেশার যোগ্যতার পার্থক্যের কারণেই তা এমনটি হয়ে থাকে?
একজন মানুষ এমন যিনি কোনো মজলিসে উপস্থিত হলে সকলে তাকে দেখে যেন সবাই আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত হয়। হাসিমুখে সালাম করে। তারপর সকলে কামনা করে, তিনি যেন তার পাশেই আসন গ্রহণ করেন।
একই সময় অন্য একজন সে মজলিসেই এলে কেউ তার দিকে ফিরে তাকায় না। কেউ কেউ সৌজন্য রক্ষার খাতিরে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে তার নিকট মোসাফাহা করে। কেউ তার জন্য জায়গা করে দেয় না। নিজের পাশে বসার জন্য ডাকে না। কেন এমন হয়? মূলত মানুষকে আপন করে নেয়া ও মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তার করার যোগ্যতার নৈপুণ্যতার কারণেই এমন হয়?
পক্ষান্তরে একজন বাবা বাড়িতে প্রবেশ করতেই তার সন্তানরা হাসিমুখে এগিয়ে আসে। আরেকজন পিতা ঘরে আসলে সন্তানেরা তার দিকে ফিরেও তাকায় না। সন্তানের সাথে আচরণ দক্ষতার কৌশলের পার্থক্যের কারণেই এমনটি হয়। মানুষের সাথে মেলা-মেশা ও সকলকে আপন করে নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের যোগ্যতায় ভিন্নতা দেখা যায়।
এটা স্বাভাবিক যে, কেউ মুহূর্তের মধ্যে অন্যকে আপন করে নিতে পারে, আবার কেউ পানে না। তবে মানুষকে আপন করে তাদের মনে জায়গা করে নেয়া ও নিজের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও আকর্ষণ সৃষ্টি করা খুব কঠিন কিছু নয়।
আমি মোটেও বাড়িয়ে বলছি না; এ কথাগুলো বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি। আমি দেখেছি নির্দিষ্ট ও সহজ কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করে বেশিরভাগ মানুষেরই মন জয় করা সম্ভব। তবে শর্ত হলো, সে পদ্ধতিগুলো প্রথমে আন্তরিকভাবে আত্মস্থ করতে হবে। তা অত্যন্ত সুন্দরভাবে সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ করা শিখতে হবে। উত্তম আচরণের কারণে আমাদের অজানাতেই অনেক সময় অন্যরা আমাদের প্রভাবিত হয়ে পড়ে।
এ সম্পর্কে আমার জীবনের একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা শুনুন যা এখন থেকে ১৩ বছর যাবৎ একটি সামরিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে আমি ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করি। মসজিদে যাওয়ার পথে একটি গেট আছে। একজন দারোয়ান সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। যাওয়ার পথে সব সময় তাকে দেখে আমি মুচকি হেসে সালাম করতাম। বেশিরভাগ সময় নামায চলাকালে আমার মুঠোফোন অসংখ্য এস এম এস ও মিসডকল জমা হয়ে থাকতো। এজন্য ফেরার পথে গাড়িতে বসে এসএমএস পড়তে ব্যস্ত থাকি বলে সালাম ও হাসি না দিয়েই চলে আসি।
হঠাৎ করে একদিন মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় দারোয়ান আমার রাস্তা আটকে দিয়ে বলেন, হে শায়খ! আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?
তখন আমি বললাম, না তো! কেন? তিনি বলেছেন, আপনি যখন প্রবেশ করেন, আমাকে দেখে হাসিমুখে সালাম দেন। পক্ষান্তরে আপনি যখন বের হন, তখন হাসিও দেন না, সালামও দেন না।
বিশেষ করে ওই দারোয়ানের স্বভাব ছিলো অত্যন্ত সাদাসিধে ও স্বচ্ছ মনের অধিকারী। এরপর সে শপথ করে বলেছেন, আমার আচরণের জন্যেই তিনি আমাকে ভালোবেসেছেন। আমাকে দেখলে সে আনন্দিত হয়।
আমিও তাকে আমার ব্যস্ততার কারণ জানালাম। তখন তাঁর নিকট বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়, আমি চিন্তা করলাম, কীভাবে মানুষকে আপন করে নেয়ার দক্ষতাগুলো যখন আমাদের স্বভাবগুণে পরিণত হয়, যখন আমরা উদাসীন থাকি তখন মানুষ সেগুলো গভীরভাবে লক্ষ করলে বুঝতে পারেন।
আলোকরশ্মি:
আপনি সম্পদ উপার্জন করতে গিয়ে সম্পর্ক নষ্ট করবেন না, নিঃসন্দেহে ভালোবাসা আপনাকে সম্পদ উপার্জণের পথ খুলে দিবে।
No Comment! Be the first one.