অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতি। যা অর্থনীতির সামগ্রীক অবস্থা নিয়ে পর্যালোচনা করে। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম স্বল্পোন্নত দেশ। স্বাধীনতার চার দশকেরও বেশি সময় পার হলেও বাংলাদেশ এখনও তার কাংখিত পর্যায়ের উন্নয়ন সাধন করতে পারেনি। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি এদেশের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। এর সাথে সামাজিক অশান্তি, সন্ত্রাস, ধর্মীয় কুসংস্কার, উগ্রতা এসব তো আছেই।
এসব কারণে বাংলাদেশ আজও বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্য পীড়িত দেশ হিসেবে বিবেচিত যার মাথাপিছু আয় মাত্র ১৩১৪ মার্কিন ডলার (অর্থনৈতিক সমীক্ষা- ২০১৫)। তবে আশার কথা হল এই যে, বিগর বছরগুলোতে বিশেষ করে ১৯৯০ সালের পর থেকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত থাকার কারণে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোতে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে, মানুষের গড় আয়ু ও জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে লক্ষ্যনীয় উন্নতি হয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে।
তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার বিশেষ করে শিক্ষা ও ব্যবসা- বাণিজ্যে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে বিচার করলে উন্নয়ন যতটুকু হবার কথা ছিল ততটুকু হয়নি। এই বইয়ে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক, গতিবিধি, সেক্টর ভিত্তিক উন্নয়ন গতিধারা ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছে যাতে একজন শিক্ষার্থী এই বইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারে। এমনকি বাংলাদেশের দ্রুত উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত সুপারিশ করতে পারে।
কিভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ আগামী ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে তার বিভিন্ন দিক নির্দেশনা রয়েছে এই বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে।
সামষ্টিক অর্থনীতি
ইংরেজিতে Macro শব্দটি গ্রিক শব্দ Makros থেকে এসেছে। Makros শব্দের অর্থ রিশাল বা সমগ্র। অর্থনীতির যে শাখা অর্থনৈতিক সমস্যা ও অর্থনৈতিক কার্যাবলিকে ব্যক্তিগত বা খণ্ডিত দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা না করে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করে, তাকে বলা হয় সামষ্টিক অর্থনীতি। অর্থাৎ এককথায়, অর্থনীতির এককগুলোর সমন্বিত পর্যালোচনাই হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতি। আমরা সাময়িক অর্থনীতিকে Human Body এর সাথে তুলনা করতে পারি।
মানুষের শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একে অন্যের উপর কোন না কোনভাবে নির্ভরশীল। তাই কোন একটি অঙ্গে সমস্যা দেখা দিলে পুরো শরীরেই। সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে পুবো শরীরের Diagnosis করাটাই শ্রেয়। সামষ্টিক অর্থনীতি অর্থনীতির কোন একক খাত নিয়ে আলোচনা না করে Human Body এর মত সবগুলো খাতকে একযোগে আলোচনা করে। ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে কোন একজন ভোক্তার ভারসাম্য, উৎপাদকের ভারসাম্য, একটি ফার্ম, একটি শিল্প, একটি পণ্যের বাজার দাম, একজন ভোক্তার আয় ইত্যাদি বিষয়গুলোকে আলোচনা করা হয়।
কিন্তু সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো চলকসমূহের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করা এবং এগুলোর সাথে জড়িত সমস্যা ও সমাধানের পথ নির্দেশ করা। তাই সামষ্টিক অর্থনীতিতে একজন ভোক্তার উপযোগ সর্বোচ্চকরণের পরিবর্তে সমাজের কল্যাণ সর্বোচ্চকরণ, ব্যক্তির আয়ের পরিবর্তে জাতীয় আয়, দ্রব্যের দামের পরিবর্তে সাধারণ দামস্তর, মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রাসংকোচন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করা।
উৎপাদন, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, মূলধন গঠন, সঞ্চয়, ভোগ, জাতীয় আয় প্রভৃতি সামষ্টিক অর্থনৈতিক চলকসমূহ একই শেকলে আবদ্ধ। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির আলোচনা করা যায় না। তাই সামষ্টিক অর্থনীতি পাঠের মাধ্যমে সবগুলো চলককে একযোগে আলোচনা করা যায়।
সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
সামষ্টিক অর্থনীতি দেশের অর্থব্যবস্থার বিভিন্ন খাত বা এককসমূহকে সামগ্রিক দিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে। আধুনিককালে সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য খুবই ব্যাপক। নিম্নে সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ আলোচনা করা হলো।
১। সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে বিভিন্ন অর্থনৈতিক চলকসমূহের কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করা হয় এবং তার ভিত্তিতে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের পথ নির্দেশ করা হয়।
২। একটি নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত এক বছরে) একটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে যে চূড়ান্ত দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করা হয় তার বাজার মূল্যের সমষ্টিকে বলা হয় GNP। GNP একটি দেশের সার্বিক অর্থনীতির চিত্র তুলে ধরে।
যে দেশের GNP এর আয়তন বড় এবং জনগণের মাথাপিছু GNP বেশি সে দেশের অর্থনীতি বেশি সুদৃঢ়, তাই সামষ্টিক অর্থনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে GNP এর সঠিক পরিমাপ করা এবং GNP সর্বোচ্চ করার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক কল্যাণ সর্বোচ্চ করা।
৩। সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে বিভিন্ন সামষ্টিক চলকের ভারসাম্য মান বের করা হয়। যেমন- ভারসাম্য জাতীয় আয়স্তর, ভারসাম্য ভোগস্তর, ভারসাম্য বিনিয়োগস্তর, ভারসাম্য, সুদের হার ইত্যাদি নির্ণয় করা হয় সামষ্টিক অর্থনৈতিক মডেলের সাহায্যে।
৪। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে দু’টি বিষয় অন্যতম সমস্যা বা বাধা হয়ে দাড়ায় যথাঃ মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব। তাই মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের কারণ অনুসন্ধান, প্রভাব যাচাই, সহনীয় পর্যায়ে মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের মত জটিল অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের পথ নির্দেশ করাও সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
৫। সামষ্টিক অর্থনীতির আলোচনার অন্যতম বিষয়বস্তু হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা বেকারত্ব রোধ। কিভাবে অর্থনীতি অপূর্ণ নিয়োগ বা বেকারত্ব থেকে পূর্ণ নিয়োগে পৌছাতে পারে, কিভাবে দেশে আরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় তার উপায় নির্দেশ করাও সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
৬। আয়ের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে না পারলে জনগণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হয়। দেশে আয় বৈষম্য বিদ্যমান থাকলে বেশিরভাগ সম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোকের হাতে। কৃষ্ণীগত থাকে, আর সমাজের অধিকাংশ মানুষের ‘মুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা’ থাকে। তাই আয় বৈষম্য রোধ করে কিভাবে আয়ের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা যায় সেই ব্যাপারটিও সামষ্টিক অর্থনীতির আলোচনার অন্তর্গত থাকা উচিত।
৭। মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা ছাড়া অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকতে পারে না। মুদ্রাস্ফীতি কিংবা মুদ্রা সংকোচন দেখা দিলে সমাজের কিছু লোক উপকৃত হয়; কিছু লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুদ্রাস্ফীতি কিংবা মুদ্রাসংকোচনের মাধ্যমে মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করে। তাই সরকারের আর্থিক নীতি ও রাজস্ব নীতি এমনভাবে প্রণয়ন করা উচিত যেন তা দ্রব্যমূল্যকে স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে সামষ্টিক
৮। আধুনিককালে সরকার অর্থনীতিকেও স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। অর্থের যোগান বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানের চেষ্টা করে। তাই আধুনিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে এই বিষয়টিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
৯। একটি দেশের জনগণের সাথে অন্য দেশের জনগণের বিভিন্ন অর্থনৈতিক লেনদেন, হিসাব- নিকাশকে বৈদেশিক লেনদেন বলে। এসব লেনদেনের মধ্যে আমদানি, রপ্তানি ও মূলধনের প্রবাহ প্রবেশ করে। বৈদেশিক লেনদেন সবসময় ভারসাম্য অবস্থায় থাকে না। কখনও বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি আবার কখনও উদ্বৃত্ত দেখা দিতে পারে। BoP (Balance of Payments) এর ভারসাম্যহীনতা একটি দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
তাই এমনভাবে আমদানি-রপ্তানি নীতি কিংবা বৈদেশিক লেনদেন নীতি প্রণয়ন করতে হবে যাতে করে বৈদেশিক লেনদেনের স্থিতি বজায় রাখা হয় অর্জন করা যায়। এটাও সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য। সুতরাং উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, সামগ্রিক অর্থব্যবস্থার সমস্যা চিহ্নিত করা, সামষ্টিক চলকসমূহের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করা এবং সমস্যা সমাধানের জন্য সঠিক নীতি প্রণয়ন করা ইত্যাদি বিষয়গুলোই সামষ্টিক অর্থনীতির বিশ্লেষণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সামষ্টিক অর্থনীতির এ উদ্দেশ্যসমূহ সাধারণত আর্থিক নীতি, রাজস্ব নীতি, বৈদেশিক বিনিময় নীতিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম অনুসরণ করে অর্জন করা যায়।
No Comment! Be the first one.