প্রতিটি প্রজন্মই তাদের নিজস্ব সময়ের প্রেক্ষাপটে বেড়ে ওঠে এবং দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বর্তমান বিশ্বে Gen Z, যারা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজন্ম হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। তবে এই প্রজন্মটি অন্যান্য প্রজন্মের তুলনায় সবচেয়ে বেশি অসুখী বলে মনে করা হচ্ছে। এই নিবন্ধে আমরা Gen Z প্রজন্মের অসুখী হওয়ার কারণ, তাদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা, এবং সামাজিক ও প্রযুক্তিগত প্রভাবের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
Gen Z: ডিজিটাল প্রজন্মের সংজ্ঞা
Gen Z প্রজন্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তারা ডিজিটাল যুগে জন্মগ্রহণ করেছে এবং বেড়ে উঠেছে। এই প্রজন্ম ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, এবং স্মার্টফোনের সাথে সমান্তরালে বেড়ে উঠেছে। তারা আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেক বেশি তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর এবং বৈশ্বিক সংযোগমাধ্যমে অংশগ্রহণ করে থাকে। তবে এই প্রযুক্তিগত নির্ভরতা এবং সামাজিক যোগাযোগের ধরন তাদের মানসিক অবস্থায় প্রভাব ফেলেছে, যা তাদের অসুখী হওয়ার একটি প্রধান কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগের প্রভাব
১. অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার
Gen Z প্রজন্ম তাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি বড় অংশ প্রযুক্তির সাথে কাটায়। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, এবং অন্যান্য ডিভাইসের মাধ্যমে তারা প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করে। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে তারা নিজেদের জীবনের সাথে অন্যদের তুলনা করে এবং নিজেদের সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। এই তুলনা ও সামাজিক চাপে Gen Z প্রজন্মের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ, এবং আত্মসম্মানের অভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা
যদিও Gen Z প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুবই সক্রিয়, তারা প্রকৃত সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেশ বিচ্ছিন্ন। অনলাইন সংযোগের মাধ্যমে তারা অন্যান্যদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুললেও, বাস্তব জীবনে তাদের সম্পর্কগুলি দুর্বল। এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং একাকীত্বের অনুভূতি বাড়ায়। বাস্তব জীবনের সম্পর্কের অভাবে তাদের মানসিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তারা প্রায়ই বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্ব অনুভব করে।
মানসিক স্বাস্থ্য ও অসন্তুষ্টি
১. হতাশা ও উদ্বেগ
Gen Z প্রজন্মের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগের হার অন্যান্য প্রজন্মের তুলনায় অনেক বেশি। সামাজিক চাপ, পড়াশোনার চাপ, ক্যারিয়ারের অনিশ্চয়তা, এবং পারিবারিক প্রত্যাশা তাদের মধ্যে মানসিক চাপ বাড়ায়। অতিরিক্ত তথ্যপ্রবাহ এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চাপ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, Gen Z প্রজন্মের বড় একটি অংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে, যার মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগ অন্যতম।
২. আত্মসম্মানের অভাব
Gen Z প্রজন্মের মধ্যে আত্মসম্মানের অভাবও বেশ লক্ষ্যণীয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে তারা নিজেদেরকে অন্যদের সাথে তুলনা করে এবং প্রায়ই নিজেদেরকে কম মূল্যায়ন করে। এই তুলনার কারণে তাদের মধ্যে আত্মসম্মানের অভাব বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও, জীবনে সফল হতে না পারার ভয় এবং সামাজিক প্রত্যাশার সাথে তাল মিলাতে না পারার কারণে তারা নিজেদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। এই আত্মসম্মানের অভাব তাদের মানসিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তোলে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
১. ক্যারিয়ার ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা
Gen Z প্রজন্ম একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়ে বেড়ে উঠছে। করোনা মহামারী, অর্থনৈতিক মন্দা, এবং কর্মক্ষেত্রের পরিবর্তনের ফলে এই প্রজন্মের মধ্যে ক্যারিয়ার ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত এবং বর্তমান কর্মসংস্থানের অবস্থা নিয়ে হতাশ। এছাড়াও, ক্রমবর্ধমান শিক্ষার খরচ এবং চাকরির বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার চাপ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
২. সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাব
Gen Z প্রজন্ম একটি সময়ের মধ্যে বেড়ে উঠছে যখন সামাজিক পরিবর্তন দ্রুত ঘটছে। লিঙ্গ সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তারা অনেক সময় হতাশা ও উদ্বেগ অনুভব করে। তারা অনেক সময় নিজেদেরকে অপ্রতুল মনে করে এবং বিশ্বজুড়ে চলমান সমস্যাগুলোর সমাধানে নিজেদের অসহায় মনে করে।
পরিবর্তনের জন্য কী করা উচিত?
১. মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি
Gen Z প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিবার, বিদ্যালয়, এবং কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আলোচনা বাড়ানো উচিত। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে তা নিয়ে কথা বলা এবং প্রয়োজনে সহায়তা চাওয়া উচিত।
২. প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার
অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার Gen Z প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা উচিত এবং বাস্তব জীবনের সম্পর্ক ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ বাড়ানো উচিত।
৩. ক্যারিয়ার পরিকল্পনা ও নির্দেশনা
Gen Z প্রজন্মের ক্যারিয়ার ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটাতে সহায়ক নির্দেশনা এবং পরামর্শ প্রদান করা উচিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে ক্যারিয়ার পরিকল্পনা এবং দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করতে হবে।
উপসংহার
Gen Z প্রজন্ম দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে তাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসুখী হওয়ার প্রবণতা আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক যোগাযোগ, এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সচেতন হওয়া এবং এই সমস্যাগুলোর সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার, মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা, এবং ক্যারিয়ার পরিকল্পনায় সহায়ক নির্দেশনা Gen Z প্রজন্মকে একটি সুখী এবং সফল জীবনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই প্রজন্মের সাফল্য ও সুখে দেশের ভবিষ্যৎও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
No Comment! Be the first one.