মধ্য বয়সে অনেকেই বয়স বেড়ে যাওয়া এবং এই সংক্রান্ত নানা জটিলতা নিয়ে উদ্বেগে থাকে। প্রকৃতির নিয়মে বয়স বাড়বেই, তবে আপনি বুড়িয়ে যাবেন কি যাবেন না সেটার নিয়ন্ত্রণ অনেকটা আপনার হাতেই আছে।
অনেকেই মনে করেন কে কত বছর বাঁচবে তা নির্ভর করে জিনের উপর। কিন্তু গবেষণা বলছে, এর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। যেটি আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
বয়স কালে অসুস্থ না হয়ে, হাসিখুশি ও স্বাধীনভাবে কিভাবে জীবন কাটানো যায়, বিভিন্ন গবেষণার আলোকে আজকের এই আর্টিকেলটিতে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব।
বন্ধুত্ব
একজন বয়স্কদের রোগ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, সুস্থভাবে দীর্ঘ সময় বাঁচতে বন্ধু থাকা খুব জরুরী। দীর্ঘজীবী হওয়ার জন্য ব্যায়াম সুষম খাদ্য এবং ধূমপান পরিহার করা যেমন জরুরী, বন্ধুত্বের গুরুত্ব ঠিক তেমনি।
এর কারণ হচ্ছে, ভালো বন্ধু মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, পাশাপাশি এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং এর প্রভাবে আয়ু ও বাড়ে। তাছাড়া, কিভাবে ভালো বন্ধু বানাবেন সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে গিয়ে একজন মনোবিজ্ঞানী দুটি উপায়ের কথা বলেছেন।
প্রথমটি হল পরিবার বন্ধু-বান্ধব এবং প্রতিবেশীদের সাথে আপনার ইতিমধ্যে যে সম্পর্ক আছে, তা শক্তিশালী করতে পারেন। এজন্য তাদের সাথে বেশি বেশি সময় কাটান ও যোগাযোগ বাড়ান।
দ্বিতীয় উপায় হল আপনার যদি এমন বিদ্যমান সম্পর্ক না থাকে। তবে নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলুন। এজন্য বাড়তি প্রচেষ্টার প্রয়োজন। আপনার সাথে মিলে যায় এমন মানুষ খুঁজে পেতে, অনেক মানুষকে যাচাই করতে হতে পারে। আপনি যদি অল্প সময়ে ভালো বন্ধু খুঁজে না পান, তাহলে ধৈর্য হারাবেন না।
কারণ মনে রাখবেন সেরা বন্ধু রাতারাতি হয় না এবং সম্পর্ক গড়ে উঠতে সময় লাগে।
হাসি এবং আশাবাদী
একদম ছোট শিশুরা গড়ে ৪০০ বার হাসে। তবে বয়স যত বাড়ে হাসির পরিমাণ তত কমে। আমাদের মানসিক চাপ কমে যায়, নার্ভাস সিস্টেম জনিত চাপ হোক বা হরমোন সংক্রান্ত চাপ, গবেষণায় দেখা গিয়েছে স্ট্রেস বা উদ্বেগে ভুগছেন, এমন নারীদের হৃদরোগ স্ট্রোক বা ফুসফুসের ক্যান্সারে মারা যাওয়া সম্ভাবনা ২ গুণ বেশি এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে ৩ গুণ বেশি।
কিন্তু হাসি এবং আশাবাদী মানসিক চাপ কমায়, এতে হার্ট অ্যাটাক এর ঝুঁকি কমে। গবেষণা বলছে, হতাশা বেদী ব্যক্তিদের চেয়ে আশাবাদী মানুষের অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি ৪২ শতাংশ কম। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সুখী মানুষের অকাল মৃত্যুর হার ৩.৭ শতাংশ কম। সুখী লোকেরা কম সুখী লোকের তুলনায় ১৮% বেশি বাঁচতে পারে। তাই পরিস্থিতি যেমনই হোক, আপনার বয়স যেমনি হোক। হাসুন, কারণ হাসির চেয়ে ভালো ওষুধ নেই। এটা আপনাকে দীর্ঘজীবী করবে।
ইতিবাচক ও আশাবাদী থাকার আরেকটি উপায় হল, প্রার্থনা করা। জাপানের অকিলামা শহরে, শতবর্ষিদের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, যারা ধর্মে বিশ্বাস রাখেন এবং যার যার ধর্ম পালন করেন। তারা অবিশ্বাসীদের চাইতে এক থেকে পাঁচ বছর বেশি বাঁচেন। কারণ তারা এই জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার থাকেন। যেকোনো ধরনের বিপদজনক পরিস্থিতিতে তারা সৃষ্টিকতার কথা ভেবে সান্তনা পান।
তবে যারা ধর্মে বিশ্বাস রাখেন না, তারা ধ্যান করা, বিভিন্ন সামাজিক ক্লাবে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে বেশি দিন বাঁচার স্বাদ নিতে পারবে।
ঘুম
আপনি যদি মধ্য বয়সে এসে পৌঁছান, তাহলে প্রতি রাতে পর্যাপ্ত ঘুম হওয়া ভীষণ জরুরি। ৭ থেকে ৯ ঘন্টা ঘুম হলো আদর্শ। এর চেয়ে কম ঘুম বা এর চেয়ে বেশি ঘুম, আমাদের মস্তিষ্ক ও হার্টের কার্যকারিতার ওপর প্রভাব ফেলে।
উদাহরণস্বরূপ প্রতি রাতে ৫ থেকে ৭ ঘন্টার কম ঘুমালে, অকার মৃত্যুর ঝুঁকি ১২ শতাংশের বেশি। যেখানে কিনা প্রতি রাতে 8 থেকে 9 ঘণ্টার বেশি ঘুমালে, আপনার আয়ু ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
ঘুমের সময় আমাদের শরীরে ইন্টিগ্রেন নামের এক ধরনের আঠালো পদার্থ নিঃসরণ করে। এই ইন্টিগ্রেন ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে টিএসএলকে সাহায্য করে। টিএসএল হচ্ছে মানুষের রক্তের মধ্যে থাকে এমন একটি রোগ প্রতিরোধী কোষ।
এর প্রধান কাজ হল মানবদেহে অর্থাৎ কোন রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া আছে কিনা সেটা কি খুঁজে বের করা এবং তার প্রতিরোধ করা। কোন সংক্রমিত কোষ ঢুকে পড়লে, ইন্টিগ্রেন তাদের চিহ্নিত করে মেরে ফেলে।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন ঘুম আয়ু বাড়াতে কতটা সাহায্য করে। এটা ঠিক যে বয়সের সাথে সাথে ঘুম বিপর্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু ঘুমের সার্কেল ঠিক করার নানা পদ্ধতি রয়েছে। সেগুলো অনুসরণ করে ঘুমের রুটিন ঠিক করুন।
ঠান্ডা পানিতে গোসল
এর কারণ হচ্ছে, প্রতিদিন সকালে ঠান্ডা পানিতে গোসল কিংবা ঠান্ডা পানিতে সাঁতার কাটা একটি পদ্ধতির মাধ্যমে আমাদের শরীরের কোষে বয়স বাড়ার গতি কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি এতে ভালো কোষের সংখ্যা বাড়ে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, ডিপ্রেশনের ঝুঁকি কমে, মন প্রশান্ত ও ফুরফুরে থাকে। যা দীর্ঘায়ুর অন্যতম উদ্দেশ্য।
ব্যায়াম
আয়ু বাড়াতে নিয়মিত ব্যায়াম কিংবা কায়িক পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। আপনাকে মূলত এমন ব্যায়াম করতে হবে, যা আপনার হৃদ-স্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়াবে। এতে মূলত হৃদপিণ্ড, পেশি ও ফুসফুসের সক্ষমতা বাড়ে।
ফলে আপনার ডায়াবেটিস হবে না এবং আয়ু বাড়বে। অর্থাৎ যারা মধ্য বয়সে পৌঁছেছেন তাদের উচিত নিয়মিত হার্ট, ফুসফুস ও পেশির সক্ষমতা বাড়ানোর ব্যায়াম করা। সেটি হতে পারে নিয়মিত দ্রুত হাঁটা এবং ভার উত্তোলন। কার জন্য কতটুকু মাত্রার ব্যায়াম দরকার, সেটি একজন ফিটনেস বিশেষজ্ঞ বলতে পারবেন।
তবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির উচিত হবে সপ্তাহে 150 মিনিট ব্যায়াম করা। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যারা সপ্তাহে মাত্র ৭৫ মিনিট ব্যায়াম করেছেন, তার প্রতিদিন হয়তো 10 মিনিটের ও বেশি তাদের আয়ু ব্যায়াম না করাতে তুলনায় এক বছর ৮ মাস বেড়েছে এবং যারা সপ্তাহে ৫ থেকে ৮ ঘন্টা ব্যায়াম করেছেন, তাদের আয়ু অন্তত চার বছর বেড়েছে।
একটি পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে টানা দুই সপ্তাহ ব্যায়ামে হার্ড ও শরীরের টিস্যু শক্তিশালী হয়, ফুসফুস বেশি পরিমাণে অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে, রক্তনালী গুলো আগে থেকে আরও বেশি ইলেসট্রিকের মত মজবুত হয়। এবং নতুন লোহিত রক্তকণিকা পেশিতে অক্সিজেন সরবরাহ করে।
কিন্তু আপনার ব্যায়ামের সুফল নষ্ট হয়ে যেতে পারে, যদি আপনি টানা এক বা দুই ঘন্টা বসে থাকেন। এক্ষেত্রে আপনি আধা ঘন্টা পর পর চেয়ার থেকে উঠে হাটা বা উঠবস করতে পারেন।
খাবার
কথায় আছে আমরা সেটাই যা আমরা খায়। বুঝতেই পারছেন আয়ুর সাথে খাবারের যোগটা কতটা ঘনিষ্ঠ। এজন্য একজন ডক্টর পরামর্শ দিয়েছেন, মধ্যবয়সীদের নিয়মিত ডায়েট করা এবং ডায়েটে রাখতে বলেছেন শস্য, বাদাম, শাকসবজি ফল এবং পরিণত পরিমানে মাছ।
সেই সাথে বন্ধ করতে বলেছেন চিনি যুক্ত পানীয় এবং প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়া। মধ্য বয়সে খাদ্যাভাসের এই পরিবর্তন তাদের গড় আয়ুর আগের তুলনায় দশ বছর বাড়াতে পারে। এমনকি যাদের বয়স ৭০ বছরেরও বেশি, তাদের আয়ু আরো পাঁচ বছর বাঁচতে পারে যদি তারা পরিমিত স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে শুরু করেন।
এই ডায়েট এক এক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম। তাই একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শে, নিজের ডায়েট চার্ট তৈরি করে, সেটি মেনে চলুন।
জাপানের একটি শতবর্ষি ব্যক্তিদের উপর গবেষণা করে দেখা গিয়েছে, তাদের দীর্ঘায়ুর বড় একটি কারণ তারা বুরি ভজ করেন না। পেটের অন্তত ২০ শতাংশ ফাঁকা রাখেন। এতে বয়স বাড়ার গতি কমে যায়।
এছাড়া আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যারা ক্যালোরি কমানোর ডায়েট করেন। তাদের শরীরের কোষ সুস্থ থাকে। এবং ডি এন এ মেরামত হতে থাকে। যা শতবর্ষি মানুষদের খুব সাধারন বৈশিষ্ট্য।
বয়সকালে ক্যান্সার হ্রদরোগে ঝুঁকি এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। এতে তাদের দেখেও বয়সে তুলনায় তরুণ লাগে। মার্কিন এর একজন গবেষক এর মতে, সুস্থভাবে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকে এজন্য আপনারা যে, চারটি কাজ জীবনে যুক্ত করবেন, তা হলো সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, সামাজিক সম্পর্ক এবং ঘুম।
এবং যে চারটি জিনিস এড়িয়ে চলবেন, তা হল মানসিক চাপ, ধূমপান, মদ পান এবং মাদক সেবন। তাছাড়া আরেকটি বিষয় দাঁতের যত্ন নিতে হবে। এসব নিয়ম মেনে চললে বয়স কালেও নিজেকে ধরে রাখতে পারবেন সজিব ও প্রাণবন্ত। স্বাস্থ্য বিষয়ক এমন নানারকম তথ্য পেতে আমাদের সাথে থাকুন।
No Comment! Be the first one.