উকুন দূর করা তিনটা ঘরোয়া উপায় নিয়ে আজকের এই আর্টিকেলটিতে আলোচনা করব। প্রথমেই বলবো একটা ওষুধের নাম যা একবার ব্যবহার করলেই মাথার 95% উকুন চলে যাবে। তবে অনেকেই ওষুধের থেকে প্রাকৃতিক সমাধান বেশি পছন্দ করেন। তাদের জন্য থাকছে দ্বিতীয় উপায়ে ওষুধ ছাড়ায় চুল ভিজিয়ে উকুন দূর করা। তারপর বলব ভেষজ পদ্ধতি নারিকেল তেল, নিমের তেল, ভিনেগার ইত্যাদি নিয়ে। তিনটা পদ্ধতি জেনে নিয়ে যেটা আপনার সুবিধা হবে সেইটা আপনি অবলম্বন করবেন।
প্রথম পদ্ধতি : ঔষধ
উকুন দূর করার অনেকগুলো ওষুধ রয়েছে। কিন্তু আজকে আমি এমন একটি ঔষধের নাম বলবো, যেটি আপনি কোন ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই নিজে নিজে ফার্মেসি থেকে কিনে এনে ব্যবহার করতে পারবেন।
বাংলাদেশের বাজারে আপনি এই ওষুধটি Alice অথবা Licnil নামে পাবেন এবং এর দাম সম্ভবত ১২০ টাকা থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। যারা ভারত কিংবা আমেরিকা থেকে এই আর্টিকেলটি পড়ছেন আপনারা Iver Shine Lotion অথবা Ivrea Shampoo এই নামে ওষুধটি কিনতে পারবেন।
এখন এই ওষুধটি ব্যবহারের নিয়ম বলে দিচ্ছি, ছয় মাস বা তার বেশি বয়সের ব্যক্তিরা এই ওষুধটি ব্যবহার করতে পারবেন। চুল শুকনা অবস্থায় মাথার তালুতে প্রথমে ওষুধটি লাগাবেন এবং তারপর চুলের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত ওষুধটা লাগাবেন।
এই ধাপটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পুরো মাথা তালু আর সবগুলো চুলের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত যেন ওষুধটি মাখানো হয়। তারপর ঘড়ি ধরে দশ মিনিটে এভাবে রেখে পানি দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলবেন। চুলে শ্যাম্পু করতে চাইলে অন্তত ২৪ ঘন্টা পরে করবেন। আর অবশ্যই সাথে সাথে শ্যাম্পু বা সাবান মাথায় ব্যবহার করবেন না।
এই ওষুধটা একবার লাগালে সাধারণত মাথা সব উকুন মারা যায়। ২০১০ সালের usa এর ১৩ টা শহরে করায় গবেষণায় দেখা গেছে, এই ওষুধ একবার ব্যবহারে ৯৫% মানুষের মাথার উকুন একদম মারা গেছে।
ব্যবহারে সাবধানতা :
এই ওষুধ কতটা নিরাপদ? পার্শ্ব- প্রতিক্রিয়া কি? সবাই কি ব্যবহার করতে পারবে? উত্তর হচ্ছে উকুন দূর কিংবা মারার জন্য এটা খুবই নিরাপদ একটি ওষুধ।
USA তে এটা Over The Counter (OTC) ঔষধ। বছরের পর বছর মনিটর করার পর যখন দেখা যায় একটা ওষুধ খুবই নিরাপদ বা কার্যকর যেটার কোন সাইড ইফেক্ট নেই এবং ডাক্তারি তথ্যাবধান ছাড়াই মানুষ এই ওষুধ ব্যবহার করতে পারে, সেসব ঔষধ গুলোকে OTC বা Over The Counter ওষুধ হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়।
তবে এখানে দুইটা ব্যতিক্রম আছে। যারা গর্ভবতী বা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন তারাও ব্যবহারের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। আর এই ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে আছে খুশকি হওয়া, চামড়া জ্বালাপোড়া, চামড়া খুশকো হওয়া, চোখে গেলে চোখে যন্ত্রণা হওয়া ইত্যাদি।
অবশ্যই খেয়াল রাখবেন চোখে যেন না যায় এবং যদি চলে যায় তাহলে হালকা পানি ব্যবহার করে চোখ ধুয়ে নিবেন।
দ্বিতীয় পদ্ধতি : প্রাকৃতিক উপায়
যারা ওষুধ নিতে চান না এবং কোন ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া চান না, তাদের জন্য এই দ্বিতীয় পদ্ধতি। এই পদ্ধতিটাই আমি প্রথমে ব্যবহার করা পরামর্শ দিব। এই পদ্ধতিতে উকুন দূর করতে মোট দুই সপ্তাহের সময় লাগবে। এই দুই সপ্তাহ সময়ে ৪বার চুল ভিজিয়ে উকুনের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে হবে।
দিনগুলো হচ্ছে প্রথম, পঞ্চম, নবম ও ১৩ তম দিন। অর্থাৎ প্রতিবার চুল আঁচড়ানোর মাঝে তিনদিনের গ্যাপ থাকবে।
নিয়মটা বুঝিয়ে বলছি, উকুন দূর করার জন্য আমরা অনেকে উকুনের চিরুনি ব্যবহার করি। কিন্তু আচড়ানোর পরে আবার দেখা যায় মাথায় উকুন এ ভরে যাচ্ছে। এমনটা কেন হয়?
উকুনের চিরুনি দিয়ে আঁচড়ালে বড় উকুনগুলো পড়ে যায় কিন্তু সেই উকুন গুলো যে চুলে ডিম পেড়ে রেখেছে সেগুলো তো চুলেই থেকে যায়। এই ডিম গুলো ফুটে বের হতে সাত দিনের মত সময় লাগে। আবার সেই বাচ্চাগুলো সাত দিনের বড় হয়ে আবার নতুন করে ডিম পারা শুরু করে। এভাবে মাথা আবার উকুন এ ভরে যায়।
এই চক্রটা ভাঙতেই আমাদের এই ১,৫,৯,১৩ ফর্মুলা ব্যবহার করে ভেজা চুলে মাথা আঁচড়াতে হবে। এতে করে উকুনের ডিম, বাচ্চা উকুন, বড় উকুন সবই দূর হবে।
কি দিয়ে চুল ভেজাবেন? চুল ভালো করে তেল দিয়ে আঁচড়াতে পারেন। কিংবা পানি দিয়ে ভেজাতে পারেন। কারণ ভেজা চুলে উকুন নড়াচড়া কম করতে পারে। ফলে চিরুনি দিয়ে এনে ফেলা যায় সহজেই। প্রতিবার চিরুনি দিয়ে টান দেওয়ার পরে চিরুনি থেকে উকুন ছাড়িয়ে নেবেন।
গবেষণায় দেখা গেছে কিছু ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটা উকুন মারার কয়েকটা ওষুধের চেয়েও বেশি কার্যকরী। তাই একটু কষ্ট হলেও এইটা চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
তৃতীয় পদ্ধতি : ভেষজ উপায়
এবার আসি ভেষজ উপায়ে উকুন দূর করা নিয়ে। ইউটিউবে অনেক ভিডিও আছে যেখানে রসুন, নারিকেল তেল, নিমপাতা, ভিনেগার ইত্যাদি বিভিন্নভাবে চুলে মাখালে উকুন দূর হবে এমন একশ শতাংশ বা গ্যারান্টি দেওয়া থাকে।
রসুনের ঝাঁজ বেশি, রসুনের গন্ধ উকুন সহ্য করতে পারেনা, উকুনের দম আটকে যায়, নারিকেল তেল দিলে উকুন অক্সিজেন নিতে পারেনা এমন অনেক কিছু বলা আছে সেখানে।
গবেষণায় কি বলে সেইটা আমরা একটু জানি, ২০১৫-১৬ সালে ইরাকের একটি প্রদেশে পাঁচটি স্কুলে গবেষণা হয়েছিল। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে দেখা হয়, কোনটা উকুন দূর করে কিনা!!! তার মধ্যে ছিল রসুন আর আপেল ভিনেগার।
সেই গবেষণায় দেখা গেছে রসুন ৪৮ ঘণ্টা মাথায় দিয়ে রাখা পরেও উকুন মরেনি। আপেল ভিনেগারের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে একটি গবেষণা আসে। তারা চুলের উপর বিভিন্ন ধরনের তেল মাখিয়ে সেগুলোর উপর উকুন ছেড়ে দিয়ে দেখেছে, সেগুলোর উপর উকুন কেমন ব্যবহার করে!!!
সে গবেষণায় দেখা গেছে চুলে নারিকেল তেল বা নিমিত তেল থাকলেও উকুন ঠিকই রক্ত চুষে নিচ্ছে অর্থাৎ তার খাবার ঠিক ঠাক খেয়ে নিচ্ছে।
২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যের একটি মেডিকেল কমিটির অনেকগুলো গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখেছে, এসব তেল কোন উকুন দূর করে এমন ভালো কোন প্রমাণ নেই।
২০২১ সালের যুক্তরাজ্যের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ( যেখান থেকে ইংল্যান্ডের সব হাসপাতালের চিকিৎসার গাইডলাইন আসে ) তারাও অনেকগুলো গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখেছে, হারবাল বা ভেষজ উপায়ে উকুন দূর করার নিরাপদ কিংবা কার্যকর এমন ভালো প্রমাণ নাই। তাই তারা এটা পরামর্শ দিচ্ছে না।
আপনি চাইলে এগুলো দিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। তবে চিকিৎসকরা এ পরামর্শ দেন না। কারণ এর পক্ষে প্রমাণ খুবই দুর্বল।
যে সকল ভুল করা যাবে না
এবার আসি, যেসব ভুলের কারণে আমরা উকুন দূর করতে ব্যর্থ হই।
১. বাসার সবার মাথা চেক করতে হবে যে উকুন আছে কিনা। যাদের উকুন আছে তাদের সবাইকে একই দিনে চিকিৎসা শুরু করবেন। না হলে আবার একজন থেকে আরেকজনের মাথায় গিয়ে উকুন ছড়িয়ে যাবে।
২. যার মাথায় উকুন, তার চিরুনি, চুলের ব্রাশ প্রতিদিন দশ মিনিট গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখবেন।
৩. উকুনের চিকিৎসা শুরুর দুদিন আগে পর্যন্ত বিছানার চাদর, বালিশের কাবার, কাপড়, তোয়ালে যে সব জায়গায় উকুন লেগে থাকতে পারে, সেগুলো গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলবেন। এগুলো সম্ভব না হলে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে ব্যাগ টার মুখটা আটকে দিয়ে দুই সপ্তাহ রেখে দিবেন।
শেষ কথা
চুল ময়লা হওয়া বা অপরিষ্কার থাকার কারণে মাথায় উকুন হয় না। কারণ হচ্ছে উকুন আসে আরেকজনের মাথা থেকে। চুলে উকুন আছে বলে কেউ যদি আপনাকে নিয়ে তির্যক মন্তব্য করে বা নাক শিটকায়, তাহলে সেটা তার জানাশোনার অভাবের কারণে। উকুন হওয়ার সাথে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোন সম্পর্ক নাই।
No Comment! Be the first one.